রাগ করে বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে ১৭ বছর: দেখতে গেলেন ইউএনও
কুমিল্লা : পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ না পেয়ে ১৭ বছর আগে জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করেন মজিবুর। সৎ ভাইদের ওপর অভিমান নিয়ে বাড়ি ছাড়েন তিনি। জঙ্গলে পলিথিন দিয়ে বানানো খুপরি ঘরে বসবাস করতেন মজিবুর। কখনো অনাহারে, কখনো অর্ধহারে দিন কেটেছে তার। কিন্তু লোকালয়ে তাকে দেখা যায়নি। এখন তার বয়স প্রায় ৬০ বছর। এক চোখে সমস্যা নিয়ে ভোগা মজিবুর বিয়েও করেননি।
মজিবুর দেবিদ্বার (কুমিল্লা) গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের মাশিকাড়া গ্রামের উত্তরপাড়ার মৌলভীবাড়ির মৃত লাল মিয়ার ছেলে। জঙ্গলে খুপরি ঘরে ১৭ বছর ধরে বসবাস করছেন -এমন খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আজ সোমবার দুপুরে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমের নির্দেশনায় দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা মাশিকাড়া গ্রামের উত্তরপাড়ার মৌলভীবাড়ির জঙ্গলে মজিবের খুপরি ঘরে যান।
ইউএনও নিগার সুলতানা তার শারীরিক খোঁজখবর নেন। মজিবুর অসুস্থ হওয়ায় তাকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।
আজ সোমবার দুপুরে সেই জঙ্গলে গিয়ে দেখা গেছে, পলিথিনে মোড়ানো ছাউনির একটি ছোট খুপরিতে বসে আছেন মজিবুর। ইউএনও আসার খবর পেয়ে খুপরি ঘর থেকে নিচু হয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। এরপর জীবনের গল্প শোনান মজিবুর।
গল্পের শুরুতে মজিবুর বলেন, ‘আমার আব্বা রেলওয়েতে চাকরি করত। আব্বার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমার মাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমাদের সুখের সংসার ছিল। এ সংসারে আমিই একমাত্র ছেলে। এরপর বাবাও মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি কখনোই তাদের সৎ ভাই ভাবতাম না। আমি তাদের পড়াশোনা করিয়েছি। আজ তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমাকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আজ ১৭ বছর এ জঙ্গলে পলিথিনের খুপরি ঘরে বসবাস করছি, কেউ আমার খোঁজ নিতে আসেনি। আমার পিতার সম্পদ থেকে তারা আমাকে বঞ্চিত করেছে।’
এ সময় তিনি খুপরি ঘরে থাকা পুরাতন কিছু দলিলপত্র দেখিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ জঙ্গলে সাপ, বিচ্চু, শিয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী বসবাস করে। তারা হিংস্র হলেও কোনোদিন আমার ক্ষতি করেনি, মানুষ যতটা আমার ক্ষতি করেছে। তাই রাগ ক্ষোভে মানুষ থেকে দূরে এসে এই হিংস্র প্রাণীদের সঙ্গে বসবাস করছি। সহায় সম্বল নেই, থাকার ঘর নেই, তাই বিয়েও করতে পারিনি।’
মজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রথম সংসারে দুই ভাই ফরিদুল ইসলাম ও জহিরুল ইসলাম। দ্বিতীয় সংসারে আমি মজিবুর রহমান। সৎ ভাই ফরিদুল পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করতেন। আমি কাঁচপুর মালেক জুট মিলে চাকরি করে জহিরুলকে বিএ পাস করাই। সেই ভাই-ই পৈতিৃক সম্পত্তির ১০৫ শতাংশ জমির মধ্যে ৮৫ শতাংশ জমি লিখে নিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি আমার পৈত্রিক সম্পত্তি ফিরে পেতে চাই।’
তবে গ্রামের স্থানীয়রা বলছে ভিন্ন কথা। তারা এ প্রতিবেদককে জানান, মজিুবুর একটু দরবেশ প্রকৃতির মানুষ। সে বিভিন্ন ওরস ও মাজারে দিন কাটাত। সেই বিভিন্ন লোকজন নিয়ে বাড়িতে মাদক সেবনের আড্ডা জমাত, যার কারণে ভাইয়েরা অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে বলেন, কিন্তু তাড়িয়ে দেননি। মজিবুরই রাগে ঘর থেকে বের হয়ে যান। বের হওয়ার কয়েক বছর পর দেখি সে পাশ্ববর্তী জঙ্গলে খুপরি ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করে। যে জায়গায় সে বসবাস করছে সে জায়গাটাও তার।
মজিবুরের চাচি সুফিয়া বেগম বলেন, পৈত্রিক সম্পত্তি এখনো ভাগবাটোয়ারা হয়নি। তার সম্পদ যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে, সে নেশা ছেড়ে ভালো হয়ে বাড়ি ফিরলে তবে সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
মজিবুরের ভাতিজা আল আমিন বলেন, ‘চাচায় বিভিন্ন মেয়ে ছেলে নিয়ে বাড়িতে মাদকের আড্ডা বসাতেন। আমাদের ধার্মিক পরিবার, সে কারণে তাকে এসব ছাড়ার জন্য প্রায় বলা হতো কিন্তু তিনি এসব শুনতেন না, যার কারণে তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে কিন্তু বের করে দেওয়া হয়নি।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ‘মজিবুর অসুস্থ থাকায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া তাকে ঘর তোলার জন্য টিন বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’