আওয়ামী লীগ এমপি নিজাম হাজারীর ফাঁসি দাবি
ফেনী জেলা প্রতিনিধি : ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত খুনিদের গ্রেফতার পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকা্ন্ডের নেপথ্যে জড়িতরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকায় তারাও আড়ালে থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগ। প্রকাশ্য রাজপথে একজন জনপ্রতিনিধিকে হত্যা করা হলেও পুলিশ আধাঘণ্টা পর সেখানে উপস্থিত হওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। হত্যাকান্ডের পর জেলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এখন আর কেউ নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। গতকাল বুধবার একরামুলের দাফন শেষে দুপুরে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ফেনী-ফুলগাজী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে জনতা। অন্যদিকে এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে ফেনী মডেল থানায় নিহতের ভাই রেজাউল হক জসিম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় বিএনপির নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ওরফে মিনার ও অজ্ঞাত ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। রাতভর শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত সন্দেহে একটি লাল রঙের প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। একরামের জানাজায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় লোকজন অংশ নেন। যোগাযোগমন্ত্রী একরামুল হককে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে পরিকল্পিত ও ঠান্ডা মাথার হত্যাকান্ড বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতা মিনারকে মামলায় জড়ানো প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের অপবাদ গোচাতে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর অনেক অপকর্ম একরাম জেনে যাওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন।
প্রকাশ্য দিবালোকে ফিল্মি স্টাইলে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে, গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যা করেছে ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরামকে। গত ২০ মে সকালে ফেনী শহরের বিলাসী সিনেমা হলের সামনে দুর্বৃত্তরা গাড়িতে থাকা অবস্থায় একরামকে গুলি করে ও সাথে সাথে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
সড়ক অবরোধ নিজাম হাজারীর ফাঁসি দাবি
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামের তিন দফা জানাজা শেষে গতকাল দুপুরে বন্দুয়ার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়েছে। দাফনের পরপরই বিক্ষুব্ধ দলীয় নেতাকর্মীরা ফেনী-বিলোনীয়া সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয়। তারা বন্দুয়া বেইলি ব্রিজের একাংশ ভেঙে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুলিশ ও বিজিবি ব্যারিকেড সরানোর চেষ্টা করছে। বিক্ষুব্ধরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য ও গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে সদরের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম হাজারীর ফাঁসির দাবিতে শ্লোগান দিচ্ছে।
দলীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, ফুলগাজী পাইলট হাইস্কুল মাঠে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম, সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ দলীয় নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। বন্দুয়ায় একরামের নিজ বাড়ির সামনে জানাজা চলাকালে নিজাম হাজারী ফেনী ফিরে যান। জানাজা ও দাফনের পরপরই দলীয় নেতাকর্মী ও এলাকার লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা এ হত্যাকা-ের জন্য আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে দায়ী করেন।
তারা বলেন, বিএনপি-জামায়াতের এমন শক্তি নেই একরামের মতো নেতাকে এভাবে হত্যা করবে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের নির্দেশে একরামকে খুন করা হয়েছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর ফাঁসি দাবি করে শ্লোগান দিতে দেখা যায়। সেখানে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিচার দাবিতে উত্তপ্ত ফুলগাজী
গত মঙ্গলবার ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও ফুলগাজী আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরামকে নৃশংসভাবে গুলি করে কুপিয়ে, অগ্নিদগ্ধ পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে উত্তপ্ত ফুলগাজী উপজেলা। গতকাল জানাজা-পরবর্তী দাফন শেষে ফেনী-পরশুরাম সড়কের বন্দুয়া বেইলী ব্রিজের পাটাতন উপড়ে ফেলে একরাম সমর্থকরা। এ সময় সড়ক অবরোধ করে নেতাকর্মীরা ফেনী-২ আসনের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে শ্লোগান দিতে থাকে। মঙ্গলবার রাত থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত একরামের নেতাকর্মীরা কয়েকশ গাড়ি ভাঙচুর করেছে। এদিকে ফেনী-পরশুরাম সড়কে অবরোধ অব্যাহত রয়েছে। খুনিদের গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত এ সড়কটিতে অবরোধ চলবে বলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।
গতকাল ফুলগাজী পাইলট হাইস্কুল মাঠে একরামের জানাজা অনুষ্ঠানে উপজেলা আ’লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা একরামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে এবং তারা বলে দলীয় কোন্দলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যদি একরামকে হত্যা করতে চাইতো তাহলে উপজেলা নির্বাচনের সময় তা সম্ভব ছিল বলে উপজেলা নেতৃবৃন্দ বলেন। ফেনী শহরের জনবহুল সড়কে দিবালোকে একরামকে হত্যা করার মতো দুঃসাহস বিএনপি-জামায়াতের নেই বলে নেতাকর্মীরা উল্লেখ করেন। স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে তারা নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রকাশ্যে দোষারোপ না করলেও ইশারা-ইঙ্গিতে তাকেই হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। এদিকে জানাজা অনুষ্ঠানের পরপর বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস আলাউদ্দিন নাসিমের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো আশার বানি না পেয়ে আরো হতাশ হন নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা একরাম হত্যার বিচার না হলে ফুলগাজী-পরশুরাম অচল করে দেয়ার শপথ নেন। বিক্ষুব্ধ আ’লীগ নেতাকর্মীরা নিজাম উদ্দিন হাজারীকে একরাম হত্যার অন্যতম গডফাদার উল্লেখ করে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ফুলগাজীতে শ্লোগান দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
মামলা ও সন্দেহভাজন গ্রেফতার
একরামকে নৃশংসভাবে গুলি করে কুপিয়ে, অগ্নিদগ্ধ পুড়িয়ে মারার অভিযোগে মামলা হয়েছে। নিহত একরামুল হকের ভাই বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছে। জেলা তাঁতি দলের আহ্বায়ক এবং ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্ব চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনকে অজ্ঞাত উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হয়। এদিকে মামলা দায়েরের পর ফেনী মডেল থানা পুলিশ হত্যাকারী সন্দেহে বিভিন্ন স্থান থেকে ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত সন্দেহে একটি গাড়ি ও দু’টি মোটরসাইকেল আটক করেছে। এদিকে বিএনপি নেতা মিনারকে মামলায় জড়ানো প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, দলের অন্তদ্বন্দ্ব ও কোন্দলের কারণে অপবাদ গোচাতে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সবগুলো পত্রিকায় হত্যাকা-ের চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছাপানো হয়েছে। ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর অনেক অপকর্ম একরাম জেনে যাওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মির্জা ফখরুল উল্লেখ করেন।
এদিকে হত্যাকা-ের পর থেকে পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক বলে উল্লেখ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রকাশ্য রাজপথে একজন জনপ্রতিনিধিকে হত্যা করা হলেও পুলিশ আধাঘণ্টা পর সেখানে উপস্থিত হয়েছে বলে নেতাকর্মীরা উল্লেখ করেন। ধারণা করা হচ্ছে প্রশাসন বিষয়টি ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাংবাদিকদের কাছে পুলিশ প্রশাসন মুখ খুলতে নারাজ। এ ব্যাপারে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে বলে ফেনীর সর্বস্তরের মানুষ আশাবাদী। জনমনে যে আকাক্সক্ষা এবং সর্বত্র যে আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে পুলিশ তা আমলে নিয়ে মামলাটি সঠিকভাবে তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে বলে নিহতের পরিবার উপজেলা নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজ আশাবাদী।
ফুলগাজীতে আজ হরতালের ডাক
ফুলগাজী উপজেলা আ’লীগ আজ একরামের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে। এছাড়া আগামীকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় উপজেলা আ’লীগের উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠান এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে ১০টায় মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে, ফুলগাজী থেকে একরামের জানাজা শেষে ফেনী আসার পথে ফেনী প্রেসক্লাবের একটি গাড়িতে হামলা চালায় একরাম হত্যার বিচারের দাবিতে সড়ক অবরোধকারীরা। এতে গাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হলেও কেউ আহত হয়নি।