কাগজ সংকটে পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে সংশয়
ঢাকা : শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপতে এবার উচ্চমূল্য গুনতে হচ্ছে সরকারকে। তারপরেও নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ইতোমধ্যে কাগজের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নতুন করে সংকটের তৈরি হয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের বাইরেও অতিরিক্ত খরচের হিসাবও দিচ্ছেন পুস্তক মুদ্রণকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা বলছেন বই ছাপার প্রধান উপকরণ কাগজ সংকটের কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে সরকারকে এখন বাধ্য হয়েই যথাসময়ে বই পেতে হলে উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হবে। এদিকে বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ নিরবছিন্ন রাখতে জানুয়ারী পর্যন্ত বাজারের অন্যান্য নোট ও গাইড বই ছাপা বন্ধ রাখতেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকার যেকোনো মূল্যেই বই উৎসব পালন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নতুন বছরের প্রথমদিনেই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণ হয়ে আসছে ২০১০ সাল থেকেই। তবে এবার একসঙ্গে সব বই হস্তান্তর নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে এখন পর্যন্তন ছাপা হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ৬ কোটি। আগামী পহেলা জানুয়ারির বই উৎসবের জন্য হাতে মাত্র এক মাসের কিছু সময় বেশি বাকি। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কয়েকটি বইয়ের পান্ডুলিপি চুড়ান্ত করা নিয়েই সময় কেটে গেছে বেশ কিছু দিন।
এদিকে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী নতুন বছর থেকে পাঠদানের সিদ্ধান্ত হলেও, সেই পাঠ্যক্রম চুড়ান্ত করতে দেরী হওয়ায় বই ছাপর কাজেও বিলম্ব হয়েছে। প্রথম থেকেই এবার ১০৫টি প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপানোর দায়িত্ব দিয়েছিল এনসিটিবি। চার মাস আগে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হলেও নানা জটিলতা কাটিয়ে কিছু দিন আগে থেকে ছাপার কাজ শুরু করা হয়েছে। এরই মধ্যে কাগজ সংকট, কাঁচামাল সংকট, কাগজের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ সংকটে ব্যহত হচ্ছে বই ছাপার কাজ।
সূত্রমতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক নিয়ে এবছর প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হবে। প্রাথমিক হিসেবে এজন্য প্রয়োজন হবে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিকটন কাগজ। দেশের ৮টি প্রতিষ্ঠান বই ছাপানোর কাগজ সরবরাহ করে থাকে। মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বইয়ের কাগজের যোগান দিতে পারবে পেপার মিলগুলো। তবে চার মাস আগে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর নির্ধারিত খরচের তুলনায় কাগজের দাম ইতোমধ্যে প্রতি টনে বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। এসবসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে সময়মতো মানসম্মত বই পৌছানো নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন মূদ্রণ ও বিপনন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো: ফরহাদুল ইসলাম জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই তুলে দেয়াকেই অগ্রধিকার দেয়া হচ্ছে। অবশ্য ছাপার মাস ও কাগজের সংকট বুঝে মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা সুযোগসন্ধানী আচরণ করছে বলেও অভিযোগ এনসিটিবির চেয়ারম্যানের। প্রেসগুলোয় বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে, যে কোনো মূল্যে যথাসময়ে শিশু-কিশোরদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে চায় এনসিটিবি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবি’র একটি সূত্র জানায় নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের প্রকাশকদের দাপটেই মূলত বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপায় সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও সরকার ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপা শেষ করতে চায়। কিন্তু বাজারে কাগজের চলমান সংকটকে প্রকট করছে নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের প্রকাশকরা। তারা চড়া দামে খোলাবাজার থেকে সব কাগজ কিনে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাঠ্যবই ছাপার কাজ পাওয়া ছাপাখানা মালিকদের।
এই পরিস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে নোট-গাইড ও সহায়ক ছাপার কাজ বন্ধ রাখতে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সভাপতিকে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং নজরদারি বাড়াতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
গত ১৫ নভেম্বর পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সভাপতি বরাবর দেয়া চিঠিতে এনসিটিবি সচিব নাজমা আখতার বলেন, আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য সব পুস্তক ছাপা স্থগিত রেখে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়ার সরকারি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য ছাপাখানার মালিক ও পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্যদের অনরোধ জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে এনসিটিবি থেকে চিঠি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জানতে চাইলে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সহ-সভাপতি শ্যামল পাল জানান, আমরা চিঠি এখনও পাইনি। চিঠি পেলে অবশ্যই সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। আমরা অবশ্যই সরকারি কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করবো। তবে এই চিঠি দেয়ার আগে এনসিটিবির উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে বসা, আলোচনা করা। এতে আমরা আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারতাম।
তবে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র একাধিক সদস্য জানান, বাজারের নোট ও গাইড বই ছাপা হয় নিউজপ্রিন্টের কাগজে । আর পাঠ্যবই এই কাগজে ছাপায় না। এরপরও ভালোমানের কাগজের সংকটের জন্য আমাদের দায়ী করা হবে কেন?’
সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস সংকট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে এমনিতেই কাগজ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নিয়মিত বাড়ছে কাগজ ও অন্যান্য পণ্যের দাম। এই পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া সরকারের জন্য এবার একটি বড় চ্যালেঞ্জ।