১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবী হতাশ
রবিউল ইসলাম:
নতুন ঘোষিত পে-স্কেলে বেতন প্রায় দ্বিগুণ হলেও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় ২১ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ইতোমধ্যেই সরকারি কলেজের অধ্যাপকরা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সমন্বয় কমিটি আজ বুধবার বৈঠক করে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করার জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাবে। একই সঙ্গে কর্মচারীদের সংগঠনের নেতারাও এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারাও কর্মসূচি দেবেন।
অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নানা জটিলতা ও আর্থিক বৈষম্য দূর করতেই জাতীয় বেতন কাঠামো থেকে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করা হয়েছে। এতে সরকারি চাকরিজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। কারণ চক্রবৃদ্ধি হারে বেতন বৃদ্ধি হবে এবং এতে ১৫ বছর পর একজন কর্মচারীর বেতন দ্বিগুণ হবে।
গতকাল বিভিন্ন গ্রেডের বেশ কয়েকজন সরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ‘নতুন বেতন কাঠামোতে যেভাবে বেতন বাড়ানো হয়েছে, এতে সরকারি চাকরিতে
যোগদানের ক্ষেত্রে মেধাবীরা আগ্রহ পাবে। আর সরকার শ্রেণি বিভাজন তথা কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভাজন বিলুপ্ত করায় আমরা খুশি। কারণ কর্মচারীদের নিচুভাবে দেখা হতো। এটি ছিল খুবই সমালোচিত একটি বিষয়।’ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নিচের গ্রেডের চাকরিজীবীরা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি ভাতাগুলো বৃদ্ধি এবং পেনশন সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। কারণ আগে পেনশন সুবিধা মূল বেতনের ৮০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ করা হয়েছে। শেষ বয়সে গিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
তবে অধিকাংশই সরকারের নতুন বেতন কাঠামোতে হঠাত্ করে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। গত সোমবার মন্ত্রিসভায় নতুন পে-স্কেল অনুমোদন করা হয়। এ সময় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করার পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরা একটি প্রতিবেদন অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বেতন ও চাকরি কমিশন ২০১৩ টাইম স্কেল/সিলেকশন গ্রেড/উচ্চতর স্কেল বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। ২০০৪ সালের বেতন কমিশনও এ ধরনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তা আমলে না নেওয়ায় নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। গণকর্মচারীদের মধ্যে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের প্রাপ্যতা নিয়ে একধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রকার বৈষম্যের। এতে একদিকে যেমন বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য দেখা দিয়েছে, তেমনি একই ক্যাডারের মধ্যেও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মচারীদের মধ্যে এ বৈষম্য আরও প্রকট বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
গত জুলাই মাসে সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পে-কমিশনের সুপারিশের আলোকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাতিল করা হলে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ১৫ লাখ চাকরিজীবী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পে-কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কিন্তু বিদ্যমান চাকরিবিধি ও নিয়োগবিধির আলোকে পদোন্নতি প্রদানের সুযোগ খুবই সীমিত। কেবল বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের পদ না থাকা সত্ত্বেও সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টিপূর্বক পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। অন্য চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে এরূপ নজির নেই। সার্বিকভাবে চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি না করেই প্রদত্ত সুবিধা বাদ দেওয়া হলেও তাতে কর্মরত জনবলের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।
বিশেষ করে সেনাবাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, সিপাহি, বিজিবির সৈনিক, কারাগারের কারারক্ষী এবং ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান, সরকারি কলেজের শিক্ষক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলভুক্ত ড্রাইভারগণকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা হতে বঞ্চিত করা হলে তা একদিকে যেমন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে, অন্যদিকে তেমনি সব চাকরিজীবীর মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সমন্বয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কবির আহমেদ ভূঁইয়া গতকাল বলেন, ‘নতুন বেতন কাঠামোতে যে হারে বেতন বাড়ানো হয়েছে তা উত্সাহব্যঞ্জক। তবে আমরা গত ১৮ আগস্ট অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। তখন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মধ্যে যেকোনো একটি থাকবে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে তা রাখা হয়নি। এতে অধিকাংশ তথা ৭৫ ভাগ সরকারি চাকরিজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) আমরা বৈঠক করে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাব।’
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের স্বার্থকে ঠিক রেখে এই পে-স্কেল করেছেন। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের সুপারিশ করে নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারীদের ক্ষতি করা হয়েছে। এতে আমরা হতাশ। আমরা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছি, কীভাবে বিষয়টি নিয়ে সামনে এগুনো যায়। সারাদেশের সংগঠনগুলো কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা দেখেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।’
উল্লেখ্য, একই স্কেলে দীর্ঘদিন চাকরি করার পরও পদ না থাকায় পদোন্নতি হয় না। এ অবস্থায় নির্বাচিত কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে শর্তসাপেক্ষে উচ্চতর স্কেল দেওয়া হয়, যা সিলেকশন গ্রেড নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে ৮, ১২ ও ১৫ বছরে গিয়ে সিলেকশন গ্রেড দেওয়া হয়। পদোন্নতি না পেলেও কর্মচারীরা আর্থিকভাবে লাভবান হন।
আর সরকারি চাকরিজীবী যখন ইনক্রিমেন্ট পেয়ে স্কেলের শেষ ধাপে পৌঁছে যান তখন পদোন্নতি দিয়ে পরের স্কেলে উন্নীত করার নিয়ম। কিন্তু পদোন্নতি না দিতে পারলে তখন টাইম স্কেল দিয়ে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে টাইম স্কেল চালু হয়। ১৯৮৩ সালের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৮, ১৩, ১৬, ২০, ২৫ ও ২৮ বছর চাকরির পূর্তিতে বা বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার এক বছর পর তৃতীয় স্কেল পর্যন্ত ২টি টাইম স্কেল প্রদান করা হয়।