ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল— কীভাবে সম্ভব?

খোদা মালুম, মানসুরা আক্তারের মাথায় কত সব বিচিত্র প্রশ্নের উদয় হয়। বিনোদনের উপকরণও বটে। অন্তত সে কারণে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না।
মধ্যযুগীয় কবির সংঘর্ষে ভরা কবিতার পুরোটা বললেই তো আরো রসাত্মক হত।
“ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল,
কিছু দুর যেয়ে মর্দ রওনা হইল
ছয় মাসের পর মর্দ ছয় দিনে গেল!
লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার
শুমার করিয়া দেখে পঞ্চাশ হাজার!”
কবি-লেখকরা কত যে অলংকার দিয়ে তাদের গল্প কবিতা সাজান তার কোন লেখাজোকা নেই। একে বলে বিরোধালংকার, ইংরেজিতে paradox বা antithesis. আপাতবিরোধী স্ববিরোধী উপমা দিয়ে লেখার মধ্যে রস সঞ্চালনের প্রচেষ্টা। আজগুবি গল্প কি আর শেষ আছে? তার দুটো শোনা যাক।
এক মাতাল অন্য মাতালকে বলছে, পথে আসতে দেখলাম কৈ মাছ গাছে উঠেছে। অন্য মাতাল বলল, যত সব আজগুবি কথা, কৈ মাছ কি গরু যে গাছে উঠবে? উপমার কি ছিরি!!
অন্য এক মাতাল পথে এক জনকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি নাম আপনার? লোকটি বলল আব্বাস। মাতাল অবাক হয়ে বলল তা’হলে তো আপনি আমাদের আত্মীয়। কিভাবে? লোকটি জিজ্ঞেস করল। আপনার নাম আব্বাস আমাদের বাড়ির কাছে আছে গাব-গাছ।
মধ্যযুগীয় কবির সংঘর্ষে ভরা কবিতায় তার অসামান্য কল্পনাশক্তি ও উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ইতোমধ্যে, অনেক পন্ডিত কবিতায় কল্পনার সাথে বাস্তবের ফাঁকফোকর বন্ধ করার জন্য হাস্যকর চেষ্টা করেছেন। আমার অপরিসীম অজ্ঞতা নিয়ে তা বিচার করা ধৃষ্টতা বৈকি। তবে, তাদের যুক্তিগুলো নিবেদন করা যেতেই পারে।
ড: মোহাম্মদ আমিন নামে একজন লিখেছেন কবিতাটি নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের কোনো কবির লেখা। সেকালে হাতিয়ার নাম ছিল হাটিয়া। সে কারণে মর্দ ঘোড়ায় চড়িয়া হাটিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। তা না হয় মানা গেল, কিন্তু বাংলাদেশের যেখান থেকে রওনা দেয়া হোক না কেন, হাতিয়া ছ’মাসের পথ হয় কি করে? তাঁর আরো কিছু মন্তব্য মূল কবিতার চাইতে কম বিনোদনের উৎস নয়। আমার এ লেখার একজন সুশীল পাঠক লেখার শেষে তার আরো কিছু আজগুবি মন্তব্যের কথা গ্রন্থিত করেছেন।
অন্য একজন লিখেছেন কিছুদুর যেয়ে মর্দ রওয়ানা হইল কিভাবে? তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, উড়োজাহাজ যেমন ওড়ার আগে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখার জন্য কয়েক কিলোমিটার এমনিতেই রানওয়েতে চালিয়ে দেখেন, আমাদের সে মর্দ তেমনি ঘোড়ায় চড়ে কিছুদুর যেয়ে তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে রওনা দেন। মজার ব্যাখ্যা, তাই না? পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কি? মধ্যযুগের সে কবি চেয়েছিলেন কোন এক তথাকথিত বীরপুরুষের বীরত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ করতে। তা নিয়ে এত কাটাছেঁড়া করে তার প্রতিভাকে খাটো করে দেখার এত প্রচেষ্টা কেন?
এধরনের মন্তব্য দেখে একটা পুরনো কৌতুকের কথা মনে পড়ল। নোয়াখালী জেলার সুশীল পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে সে কৌতুকটা নিবেদন করছি। সে অঞ্চলেরই কোন স্কুলে বাংলা শিক্ষক অনুপস্থিত থাকার কারণে হেডমাস্টার মহাশয় স্কুলের মৌলভী সাহেবকে ক্লাসটি নিতে পাঠালেন। সেদিন যে কবিতাটি পড়ানোর কথা তার প্রথম দুটো লাইন দেখে অবাক,
ফুটিয়াছে সরোবরে; কমল নিকর
ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর।
প্রথমেই ফুটিয়াছে সরোবরে কমল নিকর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বললেন, বুঝছোসনি, সরোবরে পদ্মফুল ভ্যাডকাইয়া আছে।
‘ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর’, লাইনটি দেখে তার কান গরম হয়ে উঠলো, বললেন, কি বেলেল্লেপনা শোভা মনোহরের হাত ধরে আছ, তওবা তওবা।
সাহিত্যের পন্ডিত, মাতাল ও আমাদের নোয়াখালীর হুজুর না হয় আজগুবি কথা বলেন, আমাদের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাস বা কম কিসে? বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতায় তার বয়ান।
“হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
মন জুড়ানো অনবদ্য কবিতা কিন্তু প্যারাডক্সে ভরা। একশো বছরের আগেই ৯৯% লোকের জীবন শেষ হয়, হাঁটার ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়, অথচ তিনি হাঁটছেন হাজার বছর ধরে।”
নিশীথের অন্ধকারে মলয় সাগরে কিংবা বিদর্ভ নগরে এত ঘোরাঘুরির দরকার কি? দিনের আলোর কী এত অভাব পড়েছে? অশোকের ধূসর জগত বিদর্ভ নগরীতে কিসের সন্ধানে গিয়েছিলেন কে জানে? কালীদাসের মেঘদূতে প্রাচীন ভারতের সে নগরীকে বলা হয়েছে সকল পাপাচারের কেন্দ্র হিসেবে। কাব্যিক রুপায়ন বলে কথা।
বরিশালে পাখির নীড়ের মতো চোখ তোলা রমণীদের অভাব ছিল না যদিও সেখানে মহিলারা নাকি অত্যন্ত তেজী এবং তিরিক্ষে মেজাজের হয়ে থাকে। সে কারণেই কি তিনি নাটোর গিয়েছিলেন? অনেকেই সন্দেহ করেন তিনি বাস্তবে না কল্পনায় নাটোর গিয়েছিলেন।
শিল্পীর কল্পনায় বনলতা সেন
বনলতা সেনের মুখে তিনি আবিষ্কার করলেন শ্রাবস্তীর কারুকার্য, চোখে দেখতে পেলেন পাখির নীড়। কল্পনার বলিহারি যাই। দু দন্ড শান্তি তো দূরের কথা, মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য, চোখে পাখির নীড় দেখলেই তো ভুত-প্রেত মনে করে ‘য পলায়তি স জীবতি!’ মন্ত্র জপতে জপতে’ থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়’ নীতি অবলম্বন করার কথা।
প্যারাডক্স আছে বলেই তাদের কবিতা গল্প এতো ইন্টারেস্টিং। সে কারণে আপনার মনে রয়েছে কবে কোন অজানা পুঁথি সাহিত্যের চারণ কবি লিখে গেছেন ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’।
মানুষ সত্য কথার চেয়ে গুজব, কাল্পনিক রূপকথা শুনে পুলকিত হয়, এক কান থেকে আরেক কানে বিদ্যুতের মত চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। আমেরিকার এক বড় কোম্পানি ইচ্ছে করেই ভুল-ভাল ইংরেজিতে বিজ্ঞাপন দেয়। সে ভুল নিয়ে আলাপ আলোচনার ফলে কোম্পানির প্রচার এবং ব্যবসা বেড়ে যায়।
Paradox ও antithesis য়ের পাশাপাশি গল্প, কবিতা, লোকগাথায়ও fallacyএর ছড়াছড়ি। যেমন, সুন্দরবন ভ্রমণে যেয়ে এক মহিলা বাঘের ভয়ে অস্থির। সাথের লোকজন তাকে ভরসা দিয়ে বলল, তোমার চিন্তার কারন নাই, বাঘে মহিলাদের খায় না। তারা শুধু man eaters.লজিক বইয়ে একে বলে fallacy, ভ্রান্ত যুক্তি।
মহাকবি শেক্সপিয়ারও মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে fallacyএর উদাহরণ দিয়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে রাজকুমাররা ভেনিস সুন্দরী পোর্শিয়ার পাণিপ্রার্থী হয়ে জমা হলে তিনটা ছোট বাক্সের একটিতে পোর্শিয়ার ছবি রেখে বলা হলো যিনি সঠিক বাক্সটা চিহ্নিত করতে পারবেন তাঁর গলায় পোর্শিয়া মালা দিবেন। প্রথম দুই রাজকুমার ব্যর্থ হলে, প্রিন্স অব মরক্কোর টার্ন এলে তিনি দেখলেন তিনটি বাক্সের একটি সোনালী রংয়ের, উপরে লেখা What many men desire–মরক্কোর রাজকুমার ভাবলেন, একে তো সোনার বাক্স তারপর লেখা, সব পুরুষের পছন্দ, এ বাক্সে পোর্শিয়ার ছবি না থেকে পারে না। fallacy নির্ভর যুক্তি। বাক্সটা খুলে একটা চিট পাওয়া গেল। তাতে লেখা All that glitters is not gold– চকচক করিলেই সোনা হয় না।