‘স্যার’ বিড়ম্বনা
Sunday, March 26, 2023
ড. মোহাম্মদ আমীন
সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে বদলি হই। জেলা-উপজেলার নাম বলা উচিত হবে না। জেলাটি ঢাকার কাছাকাছি এবং শিল্প এলাকা।
জেলা প্রশাসক স্বাগত জানিয়ে বললেন: তোমার উপজেলার ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি খুব সেনসেটিভ লোক। ‘স্যার’ সম্বোধন করো। নইলে চেয়ার-টেবিল ভাংচুর করে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দেবেন।
চাকরি কম হয়নি। অনেক জাঁদরেল লোকের সঙ্গে কাজ করেছি। উপজেলা— এমনকি জেলা পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের কোনো সভাপতিকেও স্যার ডাকিনি। কেউ এমন উদ্ভট দাবিও করেননি। ভূতপূর্ব মন্ত্রী হলে অন্য কথা। ইনি মন্ত্রীও ছিলেন না, এমপিও না।
সবিনয়ে বললাম: এটা কী উচিত হবে?
: উচিত-অনুচিত বুঝি না। যা পরামর্শ দিলাম সেভাবে কাজ করো। তোমার আগের জনও এমন করেছে। ফলো সিনিয়র।
: আমি তো অভ্যস্ত নই।
: চাকর শব্দ হতে চাকরি শব্দের উৎপত্তি। অভিযোজন সফলতার সোপান। অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করো। নইলে চাকুরি ছাড়ো।
এরপর আর কথা চলে না। ‘জি স্যার’ বলে বেরিয়ে আসি। মনটা খারাপ, সময়টা ভালো যাবে বলে মনে হয় না। উপজেলা নির্বাহী অফিসার পূর্ব-পরিচিত— রাফ অ্যান্ড টাফ ম্যান। মনে হলো তাঁর কাছে ভিন্ন কিছু শুনব। উপজেলায় গেলাম। তিনিও জেলা প্রশাসকের মতো উপদেশ দিতে শুরু করলেন: সভাপতি সাহেবকে স্যার ডাকবে।
: তিনি কি কখনও মন্ত্রী ছিলেন?
: না।
: এমপি ছিলেন?
: না।
: আপনিও কি তাকে স্যার ডাকেন?
:আমার জন্য মাফ। উপজেলার বাকি অফিসারদের জন্য বাধ্যতামূলক। ‘স্যার’ ডাকলে তিনি খুশি হন।
: না ডাকলে?
:অফিসে গিয়ে চেয়ার-টেবিল ভাঙবে, কাগজপত্র ছিঁড়বে।
: এমনটি কখনও করেছেন?
: উপজেলা প্রকৌশলী সাহেব কয়েকদিন আগে জয়েন করেছেন। ‘স্যার’ সম্বোধন করেনি বলে সভাপতির সাঙ্গপাঙ্গ এসে অফিসের চেয়ার-টেবিল আর দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এখন ‘স্যার’ ডাকে। ঠ্যালার নাম বাবাজি।
: আমার অফিস ভাঙলে মামলা করব।
: পুলিশ তোমার মামলা নেবে কেন?
: নেবে না কেন?
: বাপ, দোহাই তোমার— যেভাবে বলছি সেভাবে করো। বয়স্ক লোক, তোমার বাপের সমান, ‘স্যার’ ডাকলে ক্ষতি কী?
: ক্ষতি নেই।
: দেখো, উল্টোপাল্টা করো না।
: করব না।
: সভাপতি সাহেব তোমার অফিসে গিয়ে বক্তৃতা দেবেন, উপদেশ দেবেন। মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করিয়ো।
: শুনব।
: তিনি বলতে শুরু করলে ঘণ্টার আগে থামেন না। অস্বস্তি প্রকাশ করো না।
: করব না।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেবের অফিস থেকে বেড়িয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার অফিসে যাই। সব অফিসারের একই মত— “সভাপতি সাহেব মারাত্মক লোক। স্যার না ডাকলে খেপে যান।”
আমার অফিসে এসে সভাপতিকে উদ্দেশ করে একটা আমন্ত্রণ পত্র লিখি। নাজিরকে দিয়ে তা সভাপতি সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিই। তাঁর বাসা দূরে নয়, আমার অফিস থেকে কয়েক মিনিট হাঁটতে হয়।
পত্রে কী লিখেছিলাম তা এখন ঠিক মনে নেই। সারাংশ বলতে পারি: “স্যার, আমি আপনার উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেছি। আপনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে আগ্রহী। তা যদি সম্ভব না হয় তো আমার অফিসে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক সময় দিয়ে বাধিত করবেন।”
সভাপতি সাহেব আমার ভক্তিমাখা পত্র পড়ে মহাখুশি। তিনি নাজিরকে সাদরে আপ্যায়ন করলেন। আসার সময় আমার জন্য গাছ হতে এক থলে পাকা আম পেড়ে দিলেন। নাজির মহাখুশি। এমন ব্যবহার আর কারও সঙ্গে তিনি করেননি।
পত্র দিয়ে আমি সভাপতিকে যাছাই করছিলাম। বুঝলাম তিনি চালাক নন, বোকা। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ— ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি হয়েও বুঝতে পারলেন না।
নাজির বললেন: সভাপতির বাসায় যেতে হবে না। তিনি আসবেন।
: কখন আসবেন?
: আগামীকাল।
আমি ঢাকা থেকে একটা দামি তোয়লে এনেছিলাম। সেটি অফিসে নিয়ে আসি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে একটি ভালো চেয়ার নিয়ে আমার পাশে রাখি। দামি তোয়ালেটা রাখার পর চেয়ারটা রাজকীয় দেখাচ্ছে। মন্ত্রী-সচিবের সফরে এমন করা হয়। অফিসের সব লোক আমার কাণ্ড দেখে ক্ষুব্ধ— “একজন সভাপতি, যিনি জোর করে ‘স্যার’ ডাক আদায় করেন তাঁর আগমন এমন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়াকে মেনে নিতে পারছিল না। তারা আমাকে মেরুদণ্ডহীন অফিসার ধরে নিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছিল। কিন্তু প্রতিবাদও করতে পারছিল না।”
বিকেলে নাজিরকে বাজারে পাঠিয়ে গ্লাস, কাপ-পিরিচ, নাস্তা ইত্যাদি আনিয়ে নিই। মিষ্টির দোকান পাশে। দোকানদারকে স্পেশাল মিষ্টি বানাতে বলে দিই। সব ঠিকঠাক, রীতিমতো রাজকীয়।
পরদিন ঠিক সময়ে সভাপতি সাহেব ছয় জন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির। তাঁর আগমন সংবাদ পেয়ে বারান্দায় বেড়িয়ে আসি: স্যার, আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, স্যার. . .।
: আপনি খুব ভালো অফিসার।
: স্যার, আপনার দয়া স্যার।
অফিসের পিয়ন বাসেত ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে। ক্লিনার মনীন্দ্রের হাতে গামছা। সভাপতি সাহেব রুমে ঢুকে হাসিতে উদ্বেল। নতুন চেয়ার, নতুন তোয়ালে, সবার গায়ে নতুন পোশাক। তার মনটা গর্বে তিন হাত।সভাপতি সাহেব চেয়ারে বসার আগে আমাকে বসার অনুরোধ জানান।
বললাম: স্যার, আগে আপনি বসুন। স্যার, আপনি আমাদের মুরব্বি, উপজেলার নেতা। স্যার, আপনার জন্য আমার সবাই নতুন জামা পরেছি।
তিনি আরও খুশি, আরও বিগলিত। সভাপতি সাহেব চেয়ারে বসার পর আমি ডাক দিই: বাসেত স্যার, ওহ্ বাসেত স্যার; আপনি কই স্যার?
ফুলের তোড়া নিয়ে পিয়ন বাসেত দৌঁড়ে আসে। আমি তোড়াটা নিয়ে সভাপতি সাহেবের দিকে এগিয়ে দিই। চেয়ারে বসার সময় সভাপতির চোখেমুখে যে উৎফুল্লতা ছিল পিয়নকে ‘স্যার’ ডাকার পর তা আর নেই।
আমি, সভাপতির সাঙ্গদের বসার অনুরোধ জানিয়ে ডাক দিই: মনীন্দ্র স্যার, ও মনীন্দ্র স্যার, আপনি কোথায়?
ক্লিনার মনীন্দ্র দৌড়ে রুমে ঢুকে: স্যার আমাকে ডেকেছেন?
বললাম: ক্লিনার স্যার, আপনি গিয়ে অফিসের সব স্যারকে আসতে বলুন।
ক্লিনারকে ‘স্যার’ ডাকার পর সভাপতি সাহেব আরও হতভম্ব। ততক্ষণে অফিসের সবাই হাজির। পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর সভাপতি সাহেবকে আমাদের উদ্দেশে কিছু বলার অনুরোধ জানাই। তিনি একদলা চানাচুর মুখে দিতে দিতে বললেন: শরীরটা ভালো লাগছে না। আজ কিছু বলব না। আরেক দিন।
সভাপতির সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে তাকিয়ে বললাম: স্যার, আপনারা কিছু বলবেন? আসুন-না স্যার!
এবার উঠে দাঁড়ান সভাপতি: আমি গেলাম।
: মিষ্টি ছিল স্যার।
: আমি মিষ্টি খাই না।
: আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার এনেছিলাম স্যার।
সভাপতি কিছু বলার আগে আমি ডাক দিলাম: নাজির স্যার, ওহ নাজির স্যার, মেথর স্যার কই? তাঁকে আমার রুম থেকে উপহারটা নিয়ে আসতে বলুন।
উপহার আনা হলো। নাজির সাহেব তা সভাপতির ড্রাইভারের হাতে তা তুলে দিলেন। সভাপতি সাহেব গম্ভীর। কোনো কিছু না বলে সোজা গাড়িতে। আমি সালাম দিয়ে বললাম, আবার আসবেন স্যার।
আধঘণ্টা পর জেলা প্রশাসক রিং করলেন: সভাপতি সাহেবের সঙ্গে তুমি কী করেছ?
: আপনার কথামতো ‘স্যার-স্যার করেছি।
: তুমি নাকি পাগল।
: কে বলেছেন?
: সভাপতি।
: কী করলাম আমি?
ক্লিনার, পিয়ন, নাজির, সহকারী, ড্রাইভার এমনকি মেথরকেও না কি ‘স্যার’ ডাকা শুরু করেছ? সভাপতি তোমাকে নিয়ে কী বলেছেন জানো?
: কী বলেছেন?
: কী একটা পাগল পাঠালেন ডিসি সাহেব; ক্লিনার থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাইকে ‘স্যার’ ডাকে।
: সভাপতি কী রুষ্ট হয়েছেন?
: না, তিনি বলেছেন তোমার আর তাঁকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে না।
: তাহলে ক্লিনার-পিয়নদেরও ডাকব না।
এরপর হতে তিনি স্যার ডাকের জন্য উপজেলার কোনো অফিসারকে আর জোরাজোরি করতেন না। উপজেলার কোনো অফিসার ইচ্ছা হলে ডাকতেন অন্যথায় নয়।