এম দিলদার উদ্দিনের প্রেমের গল্প : যাত্রা পথের সঙ্গী
এম দিলদার উদ্দিন
——————————–
চট্টগ্রাম থেকে এসি বাসে ঢাকা যাচ্ছি। মাঝ বরাবর আমার সিট। আমার পাশের সিটে যাত্রী নেই, অন্য সব সিটে যাত্রী বসা। এ বাস কোম্পানীর নিয়ম হলো প্রয়োজনে সিট ফাঁকা থাকবে, তবুও কোন নারীর পাশে পুরুষকে সিট দেবে না। লেডিজ সেফটি ব্যানারের এ বাস কোম্পানির নিয়ম আমার আগে থেকেই জানা ছিল। হয়তো সামনের যে কোন স্টেশন থেকে আমার পাশে অন্য একজন পুরুষ যাত্রী উঠতে পারেন। শহরের বেশ কয়টি স্টেশন পেরিয়ে অলংকার পৌঁছাতেই এসির শীতল হাওয়ায় আমার ঘুম এসে যায়। সকালে কক্সবাজার থেকে এসে বোনের বাসায় উঠেছিলাম। গত তিন দিন রাতে ঘুমের বেশ ব্যাঘাত ঘটেছে। তাই ঢাকার যাত্রা পথের শুরুতে ঘুম চেপে বসে। সীতাকুন্ডে পৌঁছার আগে ডান কাঁধে একটু ভার অনুভব করলাম। চোখ মেলে দেখি একটি তুলতুলে নরম হাত আমার ডান কাঁধের ওপর, হাতের ওপর দীঘল কালো কেশে ভর্তি একটি মাথা। চুঁড়ি ভর্তি হাতের ওপর মাথা রেখে আমার কাঁধে ভর দিয়ে কে যেন ঘুমাচ্ছে, তাই চুঁড়ির এলোমেলো স্পর্শে ব্যথা পেয়ে ঘুম ভেঙ্গেছে। ডিম লাইটের আলোতে একটু একটু দেখা যাচ্ছে। আমি প্রথমে ভয়ে চমকে উঠি। যেন আজানা শিহরণে আমার মনের বাল্বগুলো জ্বলে উঠে। বিপরীত লিঙ্গের যাত্রী অনুভব করায় আমি নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে রইলাম!
আরো পাঁচ-ছয় ঘন্টা লাগবে ঢাকা পৌঁছাতে। মেয়েটি অনেকক্ষন ঘুমিয়ে ছিল। নিজামপুর ক্রস হতেই মেয়েটির চোখ খুলতেই দ্রুত আমার ডান কাঁধ থেকে তার হাত ও মাথা সরিয়ে নিলেন। মনে হল যেন এভাবে ঘুমের মধ্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পর পুরুষের কাঁধে ভর দিয়ে ঘুমিয়ে থাকায় তিনি বেশ লজ্জ্বা পেয়েছেন।
-সরি ভাইয়া, আই এম ভেরি সরি !
-না না, সরি বলার কী আছে ? রাতের ভ্রমনে অনেকেই অবচেতন মনে ঘুমিয়ে যায়। মনে মনে ভাবলাম, এইবার বোধহয় কথা বলার একটা সুযোগ পেলাম। বললাম, কোথায় থেকে উঠেছেন ?
-সিটি গেট।
-নামবেন কোথায় ?
-টিটি পাড়া। আপনি ?
-আমিও টিটি পাড়ায়। যাবেন কোথায় ?
-ধানমন্ডি, আপনি ?
-ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে। আমার পাশে আপনার সিট কীভাবে পড়ল। এটা তো পুরুষের সিট। এ গাড়িতে মেয়েদের জন্য আলাদা সিট দিয়ে থাকে।
-কী জানি? কাউন্টার থেকে ওরা বললো আপনার পাশে আরো একজন মহিলা থাকবে। বাসে উঠে দেখি আমার সিটের পাশে আপনি বসে গভীর ঘুমে নাক ডাকছেন। আর কোন সিট খালী নেই। তাই ডিস্টার্ব না করে বসে পড়লাম। কন্ডাক্টর আপনার ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছিল। আমি নো প্রবলেম বলায় সে চলে যায়। তাছাড়া আমার মধ্যে পুরুষ-মহিলার ইগো নেই।
এমন ভুল তো হওয়ার কথা নয়। তাই পকেট থেকে টিকেট বের করে মোবাইলের আলোতে দেখে নিলাম। টিকেটের পিছনে সিট প্ল্যানে ই-ওয়ানে টিক চিহ্ন দেওয়া। আমার সিট নম্বর ঠিকই আছে। তাই ওর সিট নম্বর দেখতে চাইলাম। ওর সিট নম্বর ই-টু। সবই তো ঠিক আছে। আমার পাশেরটাই ওর সিট। পারিবারিক সদস্য ছাড়া অচেনা বা অন্য পুরুষ-মহিলা এক সাথে বসার সিস্টেম এ কোম্পানির নিয়মে নেই। তাহলে ভুলটা কোথায় ? আমি আবার আমার টিকেট দেখলাম। প্রথম পাতায় মহিলা সিটে টিক দেওয়া, তার নিচে নামের ঘরে ফারহানা ইসলাম দেখে আমি খুবই লজ্জা পেলাম। আসলে ভুলটা হয়েছে আমার। গতকাল কক্সবাজার থাকা অবস্থায় আমার বড় বোনকে মোবাইলে ফোন করে বলেছিলাম, আমার জন্য একটা টিকেট কিনে রাখতে। উনি নিজে গিয়েই টিকেট কিনেছেন। তাই উনার নামেই এই টিকেট বিক্রি করা হয়েছে। তাই নিজেকে অপরাধী মনে করে কাউকে কিছু না বলে চুপ মেরে বসে রইলাম।
-ভাইয়া, আপনি ঢাকা থাকেন ?
-হ্যাঁ।
-কী করেন ?
-তেজগাঁও কলেজে বাংলা বিভাগ থেকে অনার্স কমপ্লিট করেছি, সামনে মাস্টার্স দেব। ফাঁকে ফাঁকে চাকুরীর জন্যও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আপনি ?
-আমি ঢাকা সিটি কলেজে বিএ ফাস্ট ইয়ারে। আপনার বাড়ি কোন জেলায় ?
-আমার বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে। ঢাকায় ইন্দিরা রোডে কলেজ হোস্টেলে থাকি।
-আমিও আপনার কাছাকাছি ল্যাব এইড হাসপাতালের পাশে আমাদের নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকি। বাবা চট্টগ্রাম পাহাড়তলীতে ব্যবসা করেন। এ সুবাদে আব্বা আম্মুকে নিয়ে সিটি গেটে থাকেন। ওখানে আমাদের তিনতলা একটা বাড়ি আছে। ঢাকার ফ্ল্যাটে আমার বড় খালা, খালু ও উনার দুই মেয়ের সাথে আমি থাকি।
হঠাৎ বাসের সবগুলো লাইট জ্বলে উঠে। বিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি। আপনারা এখন খেয়ে নিতে পারেন, বাথরুম বা টয়লেটের কাজ সেরে নিন, বিশ মিনিট পর বাসটি ছেড়ে যাবে বলে ঘোষণা দেয় বাসের কন্ডাকটর। আমাদের বাসটি কুমিল্লা বিশ্ব রোড হোটেল শাহজাহানের সামনে এসে দাঁড়ায়। এর আগে বাসের ডিমলাইটের মৃদু আলোতে একে অন্যের অস্তিত্ব অনুভব করেছি বটে, চেহারা বা রূপ-লাবণ্য অনুভব করতে পারি নি। গাড়ির নীলাভ আলোতে মেয়েটিকে যেন পরীর মত দেখতে পেলাম। মেয়েটিও আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে ছিল। আমি উঠে দাঁড়ালাম, মেয়েটি আমাকে সাইড দিয়ে আবার সিটে বসে।
-আপনি নামবেন না ?
-না, খিদে নেই।
-এখানে শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্যই কী যাত্রা বিরতি দেয়, অন্য আরো বিশেষ কাজ থাকতে পারে না ? নিচে নামুন, জার্নি পথে নির্ঘুম রাতে কফি খাওয়ার মজাই আলাদা। আসুন প্লিজ, কফি খাব।
কফি খাব শুনে মেয়েটির চেহারায় লোভাতুর ভাব ফুটে উঠে। আসতে হবে ?
-হ্যাঁ, আসুন।
হোটেলে ঢুকে আমরা দু’জনে দু’দিকে গেলাম, একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা ওয়াশ রুমে। ফিরে দু’জন এক কর্ণারে চেয়ারে মুখোমুখি বসি। কী খাবেন বললে সে প্রথমে বিব্রতবোধ করে। আমি তাকে দ্বিতীয় বার অনুরোধ করায় সে মৃদুস্বরে বললো :
-শুধু কফি খেতে পারি।
-খালী পেটে কফি খেতে নেই, তার আগে কী খাবেন ?
-আমার জন্য শুধু একটা চিকেন রোল বলতে পারেন।
চিকেন রোল ও দুইটা কফি অর্ডার দেওয়ার পর আমরা চোখ বাঁকিয়ে আবার কখনো কখনো সরাসরি একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। মাঝে মধ্যে আমি ইচ্ছে করে আমার দিকে তাকানোর সুযোগ করে দিয়ে আমি ওর মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করি । বুঝতে পেরেছি, আমি যতটুকু তাকে দেখেছি সে তারচেয়ে বেশি বার ও বেশি সময় আমাকে দেখেছে। মেয়েটির চেহারা আমার কাছে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। এরই মধ্যে ট্রেতে চিকেন ও কফি সাজিয়ে তা টেবিলে রেখে দিয়ে চলে যায় ওয়ের্টার।
কৌতুহলী কণ্ঠে আমি বললাম, অনেক সময় ধরে আমরা কথা বলছি। অথচ আমরা কেউ কারো নাম জানার চেষ্টা করি নি।
-কেন চেষ্টা করি নি, আমি তো অনেক আগেই আপনার নাম জেনেছি। আপনার নাম ফারহানা ইসলাম, তাই না ?
দু’জনে উচ্চস্বরে গলা ভাসিয়ে হাসতে থাকি। হাসি থামিয়ে বললাম, ফারহানা ইসলাম তো আমার বড় বোনের নাম। আমার টিকেট খানা উনি কিনেছেন, তাই এমন হয়েছে। আপনি খুবই রসিক মেয়ে।
-রসিকতার কী দেখলেন ?
-এই যে একটু আগে হাসালেন। প্লিজ, আপনার নামটা বলা যাবে ?
-আমার রেজিস্ট্রিকৃত নাম হলো ইশরাত জাহান, বাবা-মা আদর করে ছোটবেলা থেকে মনি ডাকতো, এখনো তাই ডাকছে। পরিচিত সবাই আমাকে মনি বলেই ডাকে। আপনার নাম ?
– আমার নাম নয়ন। আমি এসএসসি নিয়েছি ২০১৬ সালে। আমার সার্টিফিকেট নেইম নঈম খান নয়ন, আর আমার বাবার নাম নাঈম উদ্দিন খান নিজাম । বাবা নোয়াখালী শহরের প্রতিষ্ঠিত একজন ঠিকাদার, যদিও বাড়ি হাতিয়া দ্বীপে।
-আপনার ও আপনার বাবার দু’টো নামই সুন্দর। নয়ন ভাইয়া, হাতিয়াকে দ্বীপ বলে কেন ?
-চারদিকে বিশাল জলরাশি, তার মাঝে মাটি ও সবুজের মিশ্রনে ছোট একটা ভূ-খন্ড।
-পাহাড় আছে ?
-না, তিন দিকে মেঘনা নদী, একদিকে সাগর। নিঝুম দ্বীপের নাম শুনেছেন ?
-শুনেছি, পর্যটকরা যায় ওই দ্বীপে। ওখানে পর্যটকদের আকর্শন করে এমন কী আছে ?
-সমুদ্রের বুকে হেলে পড়ে অস্তগামী সূর্য, পাখির কলতান যেনো হাজার বছরের নিস্তব্ধতাকেও জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। ঝাকে ঝাকে মায়াবী হরিনের পদচারনায় মুখরিত এই জনপদ। যেদিকে চোখ যায় যতদূর চোখ যায় কেবল সারি সারি কেওড়া গাছ আর তার তিন কোল ঘেঁষে বয়ে চলা মেঘনা নদী, আর এক কোলে সমুদ্র যা মুহূর্তেই মায়াবী জাদুর বন্ধনে বেঁধে ফেলে পর্যটকদের মন। নদী ও সমুদ্রের বুক থেকে শুরু হয়ে সরু খাল ধরে গহীন বনের বুক চিরে এই দ্বীপটি অবস্থিত। চারিপাশে সবুজের বিচরণ। দুই দিকে বিশাল সৈকত, সেই সাথে রয়েছে সমুদ্রের স্বচ্ছ নোনা জল। চলতি পথে পানির নিচে মাছদের ছুটোছুটির দৃশ্য দেখে পর্যটকদেরকে বারবার পানিতে ঝাপিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে। এছাড়া নীমতলীতে আরও একটি বিশাল সি-বিচ যাতে রয়েছে হরেক রকমের ঝিনুক, শামুক আর মুক্তা যা কক্সবাজারের সি-বিচের মত বিশাল না হলেও পর্যটকরা এখানে খুঁজে পায় কক্সবাজারের সি-বিচকে।
-তাহলে তো এটি পর্যটকদের নিকট দর্শনীয় স্থান। ভাইয়া এবার উঠুন, গাড়ি স্টার্টের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিঝুম দ্বীপ ও হাতিয়া নিয়ে অন্য সময় আলাপ হবে। আমাদের গাড়ি নড়াচড়া করছে, দ্রুত চলুন।
মনি বিল দিতে চেষ্টা করে। ওর হাত সরিয়ে দিয়ে আমিই বিল দিয়ে দিয়েছি। দ্রুত এসে আমরা গাড়িতে উঠি। মনিকে জানালার পাশে বসিয়ে আমি হাঁটা-চলার পাশের সিটে বসলাম । কন্ডাকটর যাত্রীর আসন চেক করার পর গাড়ি আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে,আমার কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মন চাইছে সারা পথে ওর সাথে কথা বলি। ও জানালার কাঁচ দিয়ে বাহিরের দিকে মুখ ফিরিয়ে কী যেন দেখছে, যদিও এসি গাড়ির মার্কারী গ্লাস দিয়ে বাহিরের দৃশ্য তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে মগ্ন হলাম। সকাল থেকে ফেসবুক ওপেন করা হয় নি। অনেকগুলো চ্যাটের সংকেত। আমার ফেসবুক বন্ধু নীল মনির আইডি থেকে বেশ কয়েকটি চ্যাটের লাল সংকেত দেখে আমি প্রথমে ওর চ্যাট ওপেন করলাম।
x গত ৩দিন ধরে তোমার কোন খোঁজ পাচ্ছিনা। তোমার নামের পাশে সবুজ আলোও জ্বলছে না।
x তুমি কোথায় প্লিজ জানাও।
x আমি টেনশনে আছি।
x চ্যাট সিন করছো না কেন ?
x ফেসবুক ওপেন করলে আমাকে নক করবে, প্লিজ।
x ? ? ? ?
নীল মনির সাথে দু’মাস আগে ফেসবুকে আমার পরিচয়। ও ছেলে হয়ে মেয়ে সেজে আমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে কোন ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে কিনা তা এখনো আমি শিউর হতে পারি নি। তবুও শুকনো হৃদয়ে অচেনা জলে ভিজানোর চেষ্টা । গত মাস খানেক আগ থেকে ওর সাথে পরিচয়টা একটু গাঢ় হয়। পরিচয় সূত্রে আমাদের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্ব, গত বিশ দিন থেকে সম্পর্কটা আরও গভীরে গড়ায়। স্বল্প সময়ে কেউ কাউকে দেখার সুযোগ হয় নি এখনো। কক্সবাজার ভ্রমনের কথা তাকে জানিয়ে যাই নি। তাই গত কয়দিন চ্যাটে আমাকে না পেয়ে হয়তো ওর টেনশন বেড়ে গেছে। আমি আমার পাশে বসা মনি মেয়েটির দিকে তাকালাম। তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনার ঘুম পাচ্ছে মনে হয় ?
-না, একটু একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছি। দিনের বেলায় ঘুমাতে পারি নি।
-আপনার ফেসবুক থাকলে ঘাটা ঘাটি করুন, এক সময় ঘুম চলে যাবে। জার্নিতে না ঘুমানোই ভাল।
-ভাল কথাই বলেছেন। আমার একজন নতুন বন্ধু ছিল। ওকে আজ কয়দিন ফেসবুকে পাচ্ছি না। মোবাইল হাতে নিয়ে মনি বলে, হ্যাঁ পেয়েছি মনে হয়। সবুজ সিগনাল দেখা যাচ্ছে।
– বন্ধুটা কী আপনার অনেক দিনের ?
-না, কয়দিন আগ থেকে ফেসবুকে পরিচয়। তিন দিন হলো হঠাৎ সে উধাও।
-পেয়েছেন যখন চ্যাটে কথা বলুন।
-হ্যাঁ তাই করবো।
আমি ওকে ফেসবুকে ব্যস্ত করিয়ে দিয়ে নিজকে একটু ফ্রি অনুভব করলাম। ওর সামনে আমি নীল মনির চ্যাটের জবাব দিতে বিব্রত বোধ করলাম। মনির সাথে নতুন পরিচয়। তাছাড়া ওর চোখে পড়লে সে হয়তো ভাবতে পারে উনি কোন মেয়ের সাথে এ্যাংগেইজড। ওর কাছে আমার মূল্য কমাতে চাই নি। তাই তাকে ফেসবুকে ব্যস্ত করিয়ে দিয়ে আমি আমার মোবাইল বিপরীত মুখী করে প্রেয়সীর চ্যাটের উত্তর দিতে মনোযোগী হলাম। বাসের যাত্রীরা অনেকে ঘুমোচ্ছে, ওদের সমস্যা হতে পারে। তাই চ্যাট সাউন্ড অফ করে মোবাইলের আলো কমিয়ে নীল মনির প্রথম চ্যাটের জবাব দিলাম, ‘’আমি হারিয়ে যাই নি বন্ধু, তিন দিনের ট্যুরে কক্সবাজার গিয়েছিলাম’’ লিখে সেন্ড করলাম। সাথে সাথে একটা চ্যাট সাউন্ড কানে এলো। আমি মনির দিকে এক পলক তাকালাম। সেও তার নতুন বন্ধুর সাথে চ্যাটে ব্যস্ত। আমার মোবাইল চ্যাটে ওপাশ থেকে উত্তর এলো, আমাকে বলে গেলেই তো পারতে। এবার আবার লিখলাম, সময় পাই নি, হঠাৎ যাওয়া। সেন্ড বাটন টিপতেই ওপাশের চ্যাট সাউন্ড আবার আমার কানে এলো। আমি এদিক ওদিক তাকালাম, ওপাশের মোবাইলটা মনে হয় আমার অতি কাছেই অবস্থান করছে। ওপাশ থেকে আবার প্রশ্ন: তুমি এখন কোথায় ? আমি লিখলাম, আমি এখন গাড়িতে আছি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাচ্ছি লিখে আবার সেন্ড বাটনে টিপ দিয়েই আমি মনির মোবাইলের দিকে লক্ষ রাখি। ওর মোবাইলেই বার বার চ্যাট সাউন্ড বেজে উঠছে। আমি আরো শিউর হওয়ার জন্য কেবল জিরো লিখে দু’বার সেন্ড করি। এবার আমার বুঝতে বেগ পেতে হয় নি, আমার পাশে বসা মনি মেয়েটিই আমার সেই নীল মনি। আমার দু’হাত ও বুক যেন অজানা কৌতুহলে কেঁপে উঠলো ! আমার মোবাইলে চ্যাট সাউন্ড অফ করে রাখায় মনি বুঝতে পারে নি সে যে বন্ধুর সাথে চ্যাট করছে সে তার পাশেই বসে আছে। কপাল, মুখ ও গলা থেকে অনবরত ঘাম ঝরছে। মনে হচ্ছে যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টিতে ভিজছি আমি। শিউর হলাম গত দু’মাস থেকে যে নীল মনি আইডির সাথে আমি বন্ধুত্ব করে কথা বলে যাচ্ছিলাম সেটি কোন ছেলের নয়, আইডির মালিক আমার পাশেই বসে আছে। এভাবে দেখা হয়ে যাবে আমি তা কল্পনায়ও আনতে পারি নি। আনন্দ, উৎকন্ঠায় আমার শরীরের রক্ত প্রবাহ যেন বেড়ে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে বার বার ম্যাসেজ আসছে দেখে আমি আমার মোবাইল অফ করে পকেটে রেখে দিই। মনি একের পর এক ম্যাসেজ লিখে সেন্ড বাটন টিপছে। কোন উত্তর না পেয়ে এবং ‘’লাল চোখ’’ আইডির পাশ থেকে সবুজ সংকেত উধাও হয়ে যাওয়ায় সে বিরক্তিবোধ করে উচ্চস্বরে ধ্যাৎ বলে মোবাইলটি ভ্যানেটি ব্যাগে রেখে দেয়।
-কী হলো, ধ্যাৎ বলে মোবাইল রেখে দিলেন কেন ?
-শয়তান বন্ধুটা আবার উধাও। এতগুলো ম্যাসেজ সেন্ড করলাম প্রথম চারটার জবাব দিয়েই শেষ। আবার লাপাত্তা। সবুজ আলো নিভিয়ে দিয়েছে। ও কান্ডজ্ঞানহীন এক শয়তান। আমাকে টেনশনে রাখতে পারলেই ও যেন আনন্দ পায়।
-ওই ছেলেটি শয়তানি একটু বেশি করে। তাই আপনাকে টেনশনে রাখার জন্য আবার শয়তানি শুরু করেছে। একটু পরে আবার আসতে পারে। মোবাইলটা আপনার হাতেই রাখুন।
-ও যে আবার চ্যাটে আসবে আপনি কীভাবে বুঝলেন ? শয়তানেরা এমনই হয়। প্রিয় মানুষটিকে টেনশনে রাখতে পারলে ওরা এক ধরনের মজা পায়। শয়তানটা আপনার কেমন বন্ধু ?
-তেমন কিছুই নয়। প্রায় দু’মাস থেকে পরিচয়, জাস্ট একাকীত্বের সময়টা পাসিং করছি।
-ডোন্ট মাইন্ড, আমি ভেবে ছিলাম ও আপনার প্রেমিক।
-ভুল ভেবেছেন আপনি। আমি কোথায়ও কারো সাথে প্রেম করছি না। এ ছেলেটার সাথে জাস্ট অলস সময়টা পার করছি। ফ্রেন্ড বলা চলে। প্রেমিক হলে তা আপনাকে বলতাম না, গোপন রাখতাম। কেবল বন্ধু হওয়ায় তাই গোপন করি নি।
-ছেলেটাকে কখনো দেখেছেন ?
-না, দেখার সুযোগ হয় নি। অল্প কয়দিনে কাউকে বুঝা যায় না। বুঝার চেষ্টাও করি নি, যেহেতু ফেসবুকে প্রেম করে অচেনা অজানা ছেলেকে বিয়ে করে আমি সামাজিকভাবে ছোট হওয়ার পক্ষে নয় এবং আমার পরিবারকেও ছোট করতে চাই না। আমার পরিবার এমনিতে রক্ষণশীল পরিবার। আমি ফেসবুক প্রেমকে বিশ্বাস করি না।
-কেন করেন না ?
-এখানে প্রেমিক প্রেমিকারা ভুয়া আইডি, ভুয়া নাম, অন্যের ছবি ব্যবহার ও ভুয়া পরিচয় দিয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। ফেসবুক হলো স্বাধীনভাবে মিথ্যা বলার কারখানা। যে যত পারে মিথ্যে বলে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। বাস্তবে এর বিপরীত। এরপর অনেকেই অনেক প্রতারণার শিকার হয়। মেয়েরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন, পতিতালয়ে বিক্রি, বিদেশ পাচারসহ বিভিন্ন অপকর্মের শিকার হয়। মেয়ে সেজে অনেক ছেলেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে দূরে কোথায়ও নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, অসৎ মেয়েদের সাথে অশ্লীল ছবি তুলে টাকা আদায়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে।
-ফেসবুকে ভাল লোক নেই ?
-আছে, সেটা খুবই সীমিত। এই সীমিতের মাঝে ভালকে চিনে নিতে অনেকেই পারে না। ষাট বছরের বুড়ো ত্রিশ বছর বয়সের পুরনো ছবি দিয়ে আইডি খুলে নিজকে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে আবার কেউ বউ মারা গেছে দাবি করার ফাঁদ পেতে সারাক্ষণ চ্যাটে ঘুর ঘুর করে। একটা পুকুরে কয়েক হাজার মাছ থাকে। ওই পুকুরে বরশী ফেলা হলে যে কোন একটা মাছ বরশী গিলবেই। মাছ তো পানির নিচ থেকে দেখছে না বরশীওয়ালা লোকটি যুবক নাকি বুড়ো, শয়তান নাকি পিচাস, ভাল না মন্দ। মাছের খিদে আছে, তাই টোপ পেয়েই গিলে নেয়।
-আপনি যে শয়তান বন্ধুর সাথে সময় পাসিং করছেন ওই ছেলেটা কেমন?
-তাকে আমি চিনি না, জানিও না। তাই তো আমি ওর নাম দিয়েছি আপাতত শয়তান বন্ধু। যখন তাকে আমি ভাল ভাবে বুঝবো,জানবো ও চিনবো তখন হয়তো ওর নামের আগে শয়তান শব্দ বাদ দিয়ে ভাল একজন বন্ধু হিসেবে কাউন্ট করবো।
-তাহলে সে এখনো আপনার বন্ধু হতে পারে নি।
-বন্ধু বটে। ভাল বন্ধু ভাববো আরো পরে। তার আগে অনেক ধাপ পার হতে হবে।
-ওই শয়তান বন্ধুও যদি আপনাকে অনুরূপ ভাবে, তখন কী হবে ?
-ভাবাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমিও তো ভুয়া আইডি ব্যবহার করতে পারি। যেমন ধরুন আমার নাম মনি, ফেসবুকে আইডি ওপেন করেছি নীল মনি নাম দিয়ে। আমি আমার বাবার পরিচয় বললাম সচিব বা এক্স সচিব, অথচ আমার বাবা একজন সাধারন ব্যবসায়ী। এখানে একে অন্যকে অন্ধ বিশ্বাস করতে হয়। কেউ কাউকে সঠিকভাবে বুঝার বা চেনার কোন সুযোগ নেই। এটাই হলো ফেসবুক বন্ধুত্ব !
-আপনার চিন্তাধারা ও ভাবনা থেকে সুন্দর একটা মন-মানসিকতার পরিচয় পেলাম। আচ্ছা মনি আপু, শয়তান বন্ধুটার চেহারা, গায়ের রং কথা বলার ঢং ও রং যদি আমার মত হয় তাহলে তাকে আপনার পছন্দ হবে ?
-আপনার সাথে আমার জার্ণিতে ক্ষণিকের পরিচয়, ভাল করে চেনা জানা হয় নি। তাছাড়া বন্ধুত্ব একদিনের দেখাতে বা হঠাৎ করে হয় না।
-আমি আমার কথা বলি নি। ওই ছেলেটার কথা বলছি, যার সাথে আপনার একটু আগে চ্যাটিং করেছেন।
-সরি, শুধু চেহারা, গায়ের রং , কথা বলার ঢং ও রং দিয়ে কাউকে বিচার করা যায় না।
-ধরে নিন ওই ছেলেটা যদি আমি হই ! বা আমার মত অন্য কেউ হয় ?
-আপনি হবেন কেন ?
-ধরে নিন সে আমার মত।
-আপনার সাথে আরো বেশ কয়দিন আলাপ হলে হয়তো বুঝতে পারবো। গাড়িতে পরিচয়ের পর যেটুকু ধারনা পেয়েছি, আপনি মন্দ না। তবে আপনাকে ভালভাবে বুঝতে হলে আরো কয়দিন কথা বলতে হবে। সময় দিতে হবে।
-আমার সাথে কখনো কথা বলার ইচ্ছে আছে আপনার ?
-আপনাকে চেনার বা জানার ইচ্ছে আমার থাকবে কেন ? আমি তো আপনার প্রেমে পড়ি নি। আপনি এখন আমার যাত্রা পথের সঙ্গী মাত্র।
-ঠিক আছে প্রেমে পড়তে হবে না। খারাপ মেয়েরাই প্রেম করে মা-বাবার ইজ্জত ডুবায়।
-ভাল মেয়েদের প্রেম বা বন্ধুত্ব করা নিষেধ -এই থিউরি আপনি কোথায় পেয়েছেন ?
-ওকে আমি আপাতত তর্কে জড়াতে চাচ্ছি না।
আমি ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছি। সেও জানালার গ্লাসের মধ্য দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। যে নীল মনি মেয়েটার সাথে ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম সে এখন আমার পাশের সিটে বসা। একই গাড়িতে পাশাপাশি সিটে, এটা হয়তো খোদা প্রদত্ত এক অলৌকিক ভাগ্য বলা চলে। যেহেতু ওর দৃষ্টিতে আমি এখনো শয়তান বন্ধুর তালিকায় আছি, পরিচয় এখন না দেওয়াই ভাল হবে। পথও ফুরিয়ে আসছে, আর আধা ঘন্টা পর হয়তো আমরা টিটিপাড়া পৌঁছে যাব। ভবেরচর গাড়ি পৌঁছলে পিছনের সিট থেকে একজন যাত্রি নেমে যায়। আমি ওই খালি সিটে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে আবার চ্যাট ওপেন করলাম। নীল মনি তার আইডি থেকে আমার লাল চোখ আইডির চ্যাটে তিন বার জানতে চেয়েছে, তুমি এখন কতটুকু এসেছ ? পাশে বসা মনির কাছে ধরা পড়ে যাব এ ভয়ে আমি তখন ওর চ্যাটের জবাব না দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলাম। খুব সতর্কভাবে মোবাইল ডিসপ্লের আলো কমিয়ে আমি জবাব দিলাম, ‘’আমি এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাচ্ছি’’ লিখে সেন্ড বাটনে টিপ দিয়ে মোবাইলটি আড়াল করলাম। মনি তার মোবাইলে চ্যাট ইনকামিং সাউন্ড শুনে ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে নেয় এবং আমার চ্যাট পড়ে জবাব দেয়:
-আমার চ্যাটের জবাব না দিয়ে এতক্ষণ মোবাইল বন্ধ রেখেছিলে কেন ?
-গাড়িতে হঠাৎ ঘুম এসে গেল যে।
-আমিও তো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাচ্ছি। তুমি এখন কোথায় আছ ?
মিথ্যার আশ্রয় নিলাম : আমি যাত্রাবাড়ি নেমে এখন সিএনজি নিয়ে হোস্টেলে যাচ্ছি। তুমি ?
-আমি একটু আগে মেঘনা ব্রিজ পার হয়েছি মাত্র।
-কোথায় নামবে ?
-টিটি পাড়া।
-তুমি ওখানে নেমে এত ভোরে মুভ না করে ওদের কাউন্টারে দিনের আলোর অপেক্ষায় বসে থাকবে। রাস্তায় লোকজন নামলে একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় ফিরবে কেমন ?
-বাস টিটি পাড়ায় পৌঁছতে এমনিতে সকাল হয়ে যাবে।
-রিস্ক নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
-রিস্ক কেন নেব ? তাছাড়া আমার সাথে ফার্মগেট থাকে এমন একজন বড় ভাই আছেন। উনি তেজগাঁও কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র।
-ছেলেটাকে যদি তুমি ভাল মনে কর তাহলে তাকে সাথে নিয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করে একসাথে বাসায় ফিরবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে জান। বাসায় গিয়ে ঘুম দেব। বিকাল তিনটায় অবশ্যই চ্যাটে থাকবে। গত তিন চার দিন আমাকে না বলে তুমি হারিয়ে গিয়ে আমাকে খুব টেনশনে রেখেছ। এমন ভুল যেন আর কখনো না হয়।
-ভুল আর হবে না, যেখানে যাব তোমাকে সাথে নিয়ে যাব।
-সত্যি বলছ ! তুমি কী আমাকে এত ভালবাস ?
-আমি সন্দেহ করছি তোমাকে, আর তুমি সন্দেহ করছ আমাকে ?
-সন্দেহ করবো কেন ? আমি তো তোমাকে খুব ভালবাসি।
-আমি তো তোমার কাছে এখনো শয়তান বন্ধু।
-কে বলেছে তোমাকে ? অতসব আজগুবি কথা কে বলেছে তোমাকে ?
-আচ্ছা প্রিয়া, আমি বাসায় পৌঁছে গেছি। এখন রাখি, বিকালে কথা বলবো।
-ঠিক আছে, বাই বাই।
আমি চ্যাটিং শেষ করে আবার মনির পাশে গিয়ে বসি। মনির দিকে লক্ষ করলাম সেও তার মোবাইল অফ করে ভ্যানেটি ব্যাগে রাখে। মনি আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা কর্কশ কন্ঠে বলে, আপনি হঠাৎ না বলে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন ?
-পাশের সিট খালি হয়েছে দেখে ওখানে গিয়ে বসেছিলাম।
-সরি ভাইয়া, আপনি মনে হয় আমার কথায় রাগ করেছেন ?
-রাগ করলে আবার ফিরে আসব কেন ? এমনিতে গেলাম।
মনি বার বার আমার হাতের দিকে তাকায়। অবশেষে সে বলে, আপনি কিছুক্ষণ আগে পিছনের সিটে বসে এত চ্যাট কার সাথে করছেন, ?
-তুমিও তো করেছ। তা আমি তোমার পিছনে বসে দেখেছি।
-দেখেছেন, ভাল করেছেন। এখন মোবাইল পকেটে রাখুন, নামার প্রস্তুতি নিন।
-আমরা এখন কোথায় ?
-এইমাত্র সায়েদাবাদ ক্রস করেছি। আর হয়তো দুই মিনিট লাগবে। আচ্ছা ভাইয়া, একটা অনুরোধ করবো রাখবেন ?
-কী অনুরোধ ?
-ভোর হলেও মানুষ এখনো রাস্তায় নামে নি। আপনার হোস্টেল ও আমার বাসা যেহেতু কাছাকাছি, আমরা একটা সিএনজি নিয়ে এক সাথে যাই। আপনি আমাকে আমার বাসার সামনে ড্রপ করে আপনি আপনার হোস্টেলে গেলে ভাল হয়।
-তা না হয় করলাম। আমারও একটা অনুরোধ, আপনার মোবাইল নম্বরটা দিতে পারলে খুশি হব।
-কেন ভাইয়া ?
-এমনিই। কখনো প্রয়োজন হলে কথা বলবো। তাছাড়া এত ভোরে এক সিএনজি দিয়ে যাব, পথে কোন বিপদ হলে তখন মোবাইলই একমাত্র ভরসা।
-টিটিপাড়া পৌঁছে গেলাম, আগে নামুন। সিএনজিতে উঠে আমরা মোবাইল নম্বর বিনিময় করবো।
-ঠিক আছে, আপনি আগে যান, আমি আপনার পিছনে নামছি।
আমরা নামার সাথে সাথে একটা উবার পেয়ে উঠে পড়লাম। উবার ছাড়লো। দু’জনে মোবাইল নম্বর বিনিময় করলাম।
-আচ্ছা মনি আপু বলেন তো আজকের ভ্রমনটা কেমন হলো ?
-আপনি আমাকে আপু বলে লজ্জা দিলেন, আমি আপনার তিন বছরের ছোট হব।
-কাউকে সন্মান দিয়ে কথা বললে সম্নান কমে না, বাড়ে। ভ্রমনটা কেমন হলো বলুন ।
-আপনাকে পেয়ে ও পরিচিতি হয়ে ভ্রমনটা বেশ ভালই জমেছে । সারা পথে ভাল আড্ডা জমেছে। ভালই উপভোগ করলাম। আপনি আমার কোন কথায় মাইন্ড করে থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
-কেন মাইন্ড করব ?
-এই যে আপনাকে আমি বলেছিলাম, ‘’আপনাকে চেনার বা জানার ইচ্ছে আমার থাকবে কেন ? আমি তো আপনার প্রেমে পড়ি নি।‘’ এরপর আর কোন কথা হয় নি। দু’জন দু’দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম, আপনি আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন।
-এতে আমি কিছুই মনে করি নি। আপনি তো এক শয়তান বন্ধুর সাথে এ্যাংগেইজড।
-ও আসলে শয়তান না, আমি তাকে একটু একটু ভালবাসি। আমাকে না জানিয়ে সে গত তিন দিন নিখোঁজ থাকায় মনে খুব একটা রাগ উঠেছে। তাই তাকে শয়তান বললাম। আসলেই সে খুব ভাল ছেলে। সে আমাকে ভীষণ ভালবাসে।
-আপনি তাকে ভালবাসেন না ?
-অবশ্যই। আমিও তাকে খুব ভালবাসি।
-আমার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন ?
-কেন পারবো না ? আরো কিছুদিন যাক, ওর সাথে এখনো দেখা দেখি হয় নি। দোয়া করবেন যেন আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। তখন না হয় এক সময় আমরা একদিন দুপুরে তিন জন এক সাথে লাঞ্চ করবো।
-ধন্যবাদ, শুনে ভাল লাগলো। লাঞ্চ খাওয়ার অপেক্ষায় থাকলাম। আপনি গাড়িতে বললেন ফেসবুক প্রেম মিথ্যার কারখানা ।
-বলেছি তো। ওই কথা থেকে এখনো পিছিয়ে যাই নি। তাকে ভাল করে দেখা, জানা বা বুঝার সময় তো এখনো সামনেই অপেক্ষা করছে। বন্ধুত্ব, প্রেম ও ভালবাসা মানেই তো বিয়ে নয়। যারা প্রেমে পড়ে হুট করে বিয়ে করে তারাই তো বিপদে পড়ে। আমরা তো মনে হয় এসেই গেলাম। ড্রাইভার সাহেব হুলুদ বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়ান।
মনি গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া দিতে প্রস্তুতি নেয়। আমি ড্রাইভারকে বললাম, গাড়িটা আমিই ধরিয়েছি, ওর থেকে ভাড়া নিবেন না, আমি দেব। শুনে মনির চেহারাটা কাল হয়ে গেল। বললো, ভাইয়া আমাকে ভাড়া দিতে না দেওয়া হলে আমি ভীষণ মাইন্ড করবো। আপনি পরে আমাকে কল দিলেও আমি ধরবো না।
-আচ্ছা ঠিক আছে আপনিই দিন তাহলে, তবুও কল ধরা চাই।
-ঠিক আছে,ভাল থাকুন। বাই বাই।
হোস্টেলে পৌঁছে গোসল সেরে ডাইনিং গিয়ে নাস্তার পর্ব শেষ করে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম আমি।
কিছুক্ষণ পরে আমার গভীর ঘুমের মাঝে রুমের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। সিটকিনি খুলে বাহিরে তাকাতে আগুন্তক মেয়েটিকে দেখে আমি হতবম্ব হয়ে গেলাম। আরে মনি তুমি হঠাৎ এখানে ? চিনলে কীভাবে ?
-তুমি গাড়িতে আমাকে তোমার হোস্টেলের ঠিকানা বলেছিলে না, তাই চলে এলাম।
আমি মনির গায়ে শর্ট ড্রেস দেখে একটু বিচলিত হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। ওর সাজোগুঁজো চেহারা আগের দিনের চেয়েও চমৎকার জ্বল জ্বল করছে। ওর মাথায় মনে হয়েছে যেন সমস্যা থাকতে পারে। ছেলেদের হোস্টেলে এমন সাজ নিয়ে একা এলো কেন? তাছাড়া ওর সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্কও নেই। ও আমাকে ধমক দিয়ে বলে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন, এ সবই তো তোমার, আমাকে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে আমার এখানে আসা। মনির কথায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম যেন।
-রাতে এতবড় একটা জার্নি করেছ, বাসায় রেস্ট না নিয়ে ইনফরমেশন না দিয়ে হঠাৎ এখানে চলে এলে যে ? চেয়ারটায় বস। কেন এসেছ বল !
-কেন এসেছি তা কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারবে। আমি বসবো না, তুমি উঠ। দ্রুত রেডি হয়ে নাও। তোমার সাথে আজ কোথায়ও পার্কে গিয়ে ঘুরবো, মজা করব।
এ যেন মেঘ না জমতেই বৃষ্টি ঝরার মত অবস্থা। ক্ষণিকের পরিচয়ে এভাবে উপস্থিতি, আবার আমাকে নিয়ে পার্কে গিয়ে মজা করার প্রস্তাব কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
-কেন তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরবে ? তোমার ভালবাসার সেই মানুষকে নিয়ে ঘুর, আমাকে নিয়ে ঘুরবে কেন ?
-আমি যে ক্ষণিকের পরিচয়ে তোমাকে হৃদয় দিয়ে ভালবেসে ফেলেছি। কথা বলে সময় ক্ষেপন করবে না, প্লিজ রেডি হয়ে নাও। এটা হোস্টেল, এখানে এসে তোমার রুমে ঢুকে কথা বলা খুবই বেমানান। বেরিয়ে আস বলে মনি রুম থেকে বের হয়ে হোস্টেলের সামনে রাস্তায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আমার লাল শার্ট ও কালো প্যান্ট পড়ে চোখে একটা মার্কারী চশমা লাগিয়ে দামী ফারফিউম মেখে হোস্টেল রুম থেকে বের হয়ে মনির দিকে এগিয়ে গেলাম। তার আগেই মনি একটা রিকশায় চেপে বসে আছে আমার প্রতীক্ষায়। কাছে পৌঁছাতেই ও বললো, রিকশায় উঠ। আমি মনির ডান পাশে বসলাম।
-এই মনি, আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, কেন নিয়ে যাচ্ছ ?
-ভালবাসার মানুষগুলো যেথায় আড্ডা দেয় সেথায় নিয়ে যাব। চুপচাপ বসে থাক।
-তোমার না একজন শয়তান বন্ধু আছে তাকে নিয়ে যেতে পারতে।
-আমার কোন বন্ধু নেই, তুমিই আমার সেই শয়তান। গত রাতে যাত্রাপথে তুমি তোমার পরিচয় গোপন রেখেছ। এ জন্য বাসায় গিয়ে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। তাই কষ্টের প্রতিশোধ নিতে রেস্ট না গিয়ে তোমার কাছে চলে এলাম।
-কীভাবে বুঝলে আমি সেই শয়তান। সত্যিই বলছি, আমি তোমার সেই শয়তান বন্ধু নই।
-আমার আত্মাই আমাকে বলে দিয়েছে। যেহেতু ফেসবুকে আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, তোমাকে হাতের কাছে পেয়েও চিনতে পারি নি। অথচ তুমি আমাকে ঠিকই চিনে ফেলে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছ।
-মনি তুমি বিশ্বাস কর, আমি তোমার সেই শয়তান বন্ধু নই।
-বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছুই নেই। আজ আমরা সারাটা দিন পার্কে আড্ডা দেব। সন্ধ্যায় ফিরবো।
-তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালবাস ?
-সত্যিই ভালবাসি কিনা- এ প্রশ্ন কখনো করবে না। ভালোবাসার আসলে কোনো সংজ্ঞা নেই। ভালোবাসার রয়েছে কিছু আজগুবি বৈশিষ্ট, যে আজগুবি বৈশিষ্টগুলো সব ভালোবাসার মধ্যে থাকে না।
আমরা জিয়া উদ্যানের প্রবেশ পথে পৌঁছে গেলাম। রিকশা বিদায় দিয়ে মনি আমাকে হাত ধরে গায়ের সাথে জড়িয়ে টেনে টেনে পার্কের এক কোনায় ঝোপের ভিতর নির্জন একটি গাছের আড়ালে নিয়ে যায়। আমি পুরুষ, মনির চেয়ে আমার গায়ে শক্তি বেশি থাকার কথা। কিন্ত শত চেষ্টা করেও আমি আমাকে মনির বাহুর কব্জা থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারি নি। আমার শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। ঝোপের মধ্যে আমরা পাশাপাশি বসলাম। মনি নির্জনতার সুযোগে আমার গা ঘেঁসে বসে আমার গালে ফটাফট বেশ কয়টি চুম্বন একে দেয়। আমি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করায় মনি আমার যে দু’গালে একটু আগে চুমোর চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছিল, সেই চিহ্নের ওপর ফটাফট চারটে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আমি যেন অসহায়। মনি ধীরে ধীরে আমার শার্ট ও প্যান্ট খুলে নিয়ে সীমানা প্রচীরের ওপাশে ছুঁড়ে মারে, জাইঙ্গাটাই এখন আমার একমাত্র পোষাক। মনি আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত বুলাতে থাকে। আমার দেহে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শুরু হয়ে গেছে। মনির চোখ দু’টো যেন অগ্নিকুন্ড, ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভয়ে অস্থির। মনি তার পায়জামা সামান্য ফাঁকা করে আমার গায়ের ওপর চেপে বসে আমাকে ধর্ষণে উদ্যত হয়। এ সময় চার জন পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে দৌঁড়ে এসে আমাদের চার পাশ ঘিরে দাঁড়ায়। সাথে থাকা কয়জন সাংবাদিক ক্যামরা তাক করে। আমি হাটু ভাঁজ করে মুখ ও লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করি। পুলিশ আমার পিঠে লাঠি দিয়ে তিন চার ঘা আঘাত করে মুখ তুলে ক্যামরার দিকে তাকানোর নির্দেশ দেয়। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে দিলাম উলঙ্গ দৌঁড়। এ সময় হঠাৎ আমি আমার খাট থেকে নিচে পড়ে গেলাম, ঘুম ভেঙ্গে যায়। দ্রুত হাতড়িয়ে দেখি আমার কাপড়-চোপড় সবই ঠিক আছে। নেই শুধু মনি, পুলিশ আর সাংবাদিকগুলোও, হোস্টেল রুমের মেঝেতে পড়ে আছি আমি। আমার শরীর কাঁপছে, ফুল স্পীডে চালিয়ে রাখা ফ্যানের বাতাসের মধ্যেও আমার শরীর থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে। নিজেকে সামলিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে আবার খাটে এসে শুয়ে পড়ি। শরীরটা এখনও কাঁপছে। মোবাইলে সময় দেখে জানলাম সময়ের কাঁটা দুপুর দেড়টা অতিক্রম করেছে। তিনটায় নীল মনিকে চ্যাট করার কথা। চ্যাট করবো কিনা ভাবছি, স্বপ্ন দেখে মানুষ স্বপ্ন বুনে, কোন কোন স্বপ্ন মানুষকে আবার বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে যায়। ঘুম না ভাঙ্গলে পুলিশ আমাকে এতক্ষণে থানায় নিয়ে যেত, আগামী কালের পত্রিকায় হয়তো যুগল আধা উলঙ্গ ছবি দিয়ে নিউজ হতো। এ স্বপ্ন হয়তো আজ আমাকে সতর্ক বার্তা দিয়ে গেছে। আমি এখন কী করবো ভেবে কোন কূল পাচ্ছি না। আমার রুমমেট বাদল এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেল। রুমে আমি একা। বাদল থাকলে হয়তো আমার পুরো কাহিনী ওকে বলে বুদ্ধি বা পরামর্শ নিতে পারতাম। এসব ভাবনা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে আমি ডাইনিং এ দুপুরের খানা সেরে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। এমন সময় চ্যাট সাউন্ড শুনে মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুক ওপেন করি। ও পাশ থেকে নীল মনির চ্যাট:
-কী খবর, কেমন আছ ? বিকেল তিনটায় চ্যাটে আসার কথা ছিল না ?
-ছিল, ঘুমে ছিলাম। একটু আগে ঘুম থেকে উঠে দুপুরের খানা সেরে বিছানায় কাত হলাম।
-সরি বন্ধু ! ডিস্টার্ব করলাম বুঝি।
-কেন ডিস্টার্ব হবে। এ সময়ে তো আমরা চ্যাট করার কথা। ভোরে বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরতে কোন সমস্যা হয় নি তো ?
-না, আমার সাথে থাকা নয়ন নামের ওই ছেলেটা আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।
-তার সাথে তোমার পরিচয় হলো কীভাবে ?
-আমার পাশের সিটে ওর সিট। ছেলেরা তো মেয়ে দেখলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ও নিজে যেচে আমার সাথে পরিচয় করে। এতে একটু আধটু কথা বিনিময় হয়েছে। যাত্রা বিরতিতে ওই ছেলেটা আমাকে কফি ও চিকেন রোল খাইয়েছে। আমি খেতে চাই নি, জোর করে খেতে রাজি করায়।
-তারপর ?
-আর কথা হয় নি। ছেলেটি ঘুমিয়ে ছিল। আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। ফাঁকে ফাঁকে তোমার সাথে চ্যাট করি। তুমি বলাতে আমি বাস থেকে নেমে সেই নয়ন ছেলেটিকে সাথে নিয়ে এক সিএনজি নিয়ে বাসায় পৌঁছি।
-নয়ন ছেলেটা দেখতে কেমন ?
-খুবই স্মার্ট ও ভদ্র। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে।
-ওর প্রেমে পড়ে যাও নি তো ?
-কী বলছো তুমি এসব ? আমি তো তোমাকেই ভালবেসে ফেলেছি। আমি খারাপ মেয়ে না, যে এক সাথে তোমাকে ও নয়নকে ভালবাসবো। ওই ছেলেটা যতই সুন্দর ও স্মার্ট হোক আমি তোমাকেই ভালবাসি।
-আমাকে তুমি এখনো দেখ নি। আমি স্মার্টও না, ভদ্রও না। গায়ের রংটাও কালো।
-তাতে কী ? তুমিই আমার সব। তোমার দুই তিনটা ছবি আমার ইনবক্সে দিতে বলেছিলাম। তুমি আজ নয় কাল বলে বলে সময় ক্ষেপন করে যাচ্ছ। এটা ঠিক না। তাছাড়া তোমাকে আমি ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল থ্রো করলে তুমি কেটে দাও কেন ? মেয়েরা হয়তো এ ধরণের ভিডিও কল কেটে দেয়, ছেলেরা কেটে দেওয়ার কথা নয়।
-তুমি ভাবছো আমি মেয়ে হয়ে ছেলের অভিনয় করছি ?
-না তা হবে ক্যান। মেয়েরা কখনো ছেলে সেজে অযথা আরেক মেয়ের সাথে চ্যাট করে সময় ও এমবি খরচ করে না।
-আমি তোমাকে বলেছি তো, আমাদের সম্পর্কটা আরো মধুর হোক। তখন ছবিও পাঠাবো ভিডিওতেও কথা বলবো।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। রাতে কথা হবে। আমার এখন কপাল ব্যথা করছে।
-ওকে, বাই বাই।
আমি মোবাইল পাশে রেখে ভাবনায় ডুবে গেলাম। মনি তো আমি নয়নের প্রেমে পড়ে নি, ও প্রেমে পড়েছে আমার লাল চোখ আইডির সাথে। তার সাথে এখন ছবি বিনিময় করলে অথবা ভিডিওতে কথা বললে আমাকে চিনে ফেলবে। আর কয়দিনই বা আমি তার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারব ! ও এখন আমার ছবি দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। আমি এখন কী করবো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। মনি যদি জানতে পারে লাল চোখ আইডির মানুষটিই আমি নয়ন, তাহলে মনি আমাকে প্রতারক ভাবতে পারে। এমন সময় রুমমেট বন্ধু বাদল ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। বাদলকে পেয়ে আমি কিছুটা ভরসা পেয়েছি। সে হাত মুখ ধূয়ে পাশের খাটে বিশ্রামে যায়। বাদলের সাথে দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ শেষে আমি আমার মূল আলোচনায় আসি।
-দোস্ত, আমি একটা বিষয় নিয়ে খুব একটা টেনশনে আছি।
-কী বিষয়ে ?
-বিষয়টা হলো আমি লাল চোখ আইডি দিয়ে নীল মনি আইডি নামে একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি। মেয়েটা এখন আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। গতকাল চট্টগ্রাম থেকে………………………………………………………………….।
বাদল আমার মুখ থেকে পুরো কাহিনী জেনে হাসতে থাকে। ওর হাসিতে আমি বিরক্তি বোধ করলাম। বললাম, হাসছিস ক্যান ? আমি এখন কী করবো তুই একটা ভাল বুদ্ধি খাটা।
-তুই যখন চিনতে পেরেছিস তখন তুই তোর পরিচয় গোপন করা ঠিক হয় নি। এভাবে পরিচয়টা হয়ে গেলে তোরা দুই জনই গাড়িতে বেশ উচ্ছসিত হয়ে পড়তি। এ উচ্ছাসের সাথে সাথে ভালোবাসার রঙও বদলে যেতো। কেন তুই এ ভুল করেছিস। এখন তোর সামনে একটি পথ খোলা আছে, সেটা হলো তোর ‘লাল চোখ’ আইডি ডিসমিস করে দেওয়া। খুঁজে না পেলে একসময় সে হতাশ হয়ে কেটে পড়বে। তোর যদি তার সাথে প্রেম করার ইচ্ছা থাকে তুই তোর আইডি বন্ধ রাখার পাশাপাশি সরাসরি মাঝে মধ্যে ওর সাথে মোবাইলে কথা বলবি।
-মেয়েটা সুন্দরী, হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। পরিচয় না দিয়ে পাকা গুটি কাঁচা করে দিলাম।
-তুই এখন তোর সেই লাল চোখ আইডি ক্লোজড করে নে। পনের দিন পর তুই যাত্রা পথের সঙ্গী পরিচয় দিয়ে কথা বলা শুরু কর। দেখবি কেল্লাফতে।
-আইডি বন্ধ করে দিয়ে তাকে যতোই ভুলানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, প্রথম ভালবাসার মানুষটিকে মেয়েরা কখনো ভুলতে পারে না। জোর করেও কখনো কাউকে প্রেমের বাঁধনে আটকানো যায় না। ভালোবাসা পুরোপুরি একজন মানুষের একান্ত আপেক্ষিক বিষয়। আমি সেই দিন গাড়িতে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওর কথায় বুঝা গেল সে লাল চোখকেই ভালবাসে, আমাকে নয়।
-তুই তাকে চিনে ফেলেছিস এটা তো সে এখনো জানে না । তাহলে আরেকটা কাজ করা যায়।
-কী করবো ?
-তুই তোর লাল চোখ আইডি দিয়েই তাকে ধরতে পারবি।
-কীভাবে ?
-আবার যখন চ্যাট করবি তখন তোর সেই বাস ভ্রমনের সঙ্গী মেয়েটির সাথে ঘটে যাওয়া সব কাহিনী বললে এক সময় সেই বলে উঠবে আরে ওই মেয়েটি আমিই ছিলাম। দুর্ভাগ্য আমাদের পাশাপাশি বসেও আমরা একে অপরকে চিনতে পারলাম না। ও নিজেই আপসোস করবে। এতে লাল চোখ আর সফর সঙ্গী নয়ন একাকার হয়ে যাবে।
-আরও একটা পথে এগুনো যায়। লাল চোখ আইডি ক্লোজড করে আমি আমার প্রকৃত ছবি দিয়ে নয়ন নামে আইডি চালু করি। ওই আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠালে আমার ছবি দেখে সে চিনতে পেরে আমাকে এ্যাড করবেই।
-কিছুদিন অপেক্ষা কর, এরপর তাই করিস।
-ওকে।
তের দিন গড়িয়ে গেল। আজ আমি আমার নয়ন নামের নতুন আইডি থেকে নীল মনিকে ফ্রেন্ড রিক্যুয়েস্ট পাঠালাম। সাথে সাথে মনি আমাকে একসেপ্ট করে নেয়।
কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে বার্তা আসে,
-আপনি আমার সেই সফর সঙ্গী নয়ন ?
-হ্যাঁ, আমি সেই নয়ন। একসেপ্ট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ বলার আগে বলুন, আপনি আমাকে কল দেওয়ার কথা ছিল না ? দেন নি কেন ?
-কোন মেয়েকে অযথা কল দিয়ে বিরক্তি দেওয়ার অভ্যাস আমার নেই।
-তাই ! আপনার সাথে সেই দিন বাসে পরিচয় হওয়ার পর আমিও বুঝতে পেরেছি আপনি খুবই ভদ্র ছেলে।
-আমার বিষয় এখন রাখেন, আপনার ওই শয়তান বন্ধুর খবর কী ?
-ওর কথা আর বইলেন না। ও শুধু শয়তান নয়, পাক্কা শয়তান।
-কেন ? কী করেছে আবার ?
-আবারও লাপাত্তা। তার ছবি পাঠাতে বলেছি, ভিডিওতে কল দিয়েছি। ছবিও দিচ্ছে না, ভিডিও কলও ধরছে না। ফেসবুকে তাকে আর পাচ্ছিও না।
-হয়তো কোন সমস্যায় পড়েছে। কয়দিন পর আবার ফিরে আসবে হয়তো।
-এবার ফেসবুকে দেখা হলে আমি তাকে সাথে সাথে ব্লক মেরে দেব। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। ভালবাসা সম্পূর্ন একটা আবেগের বিষয়, সে আবেগ যদি বার বার বাঁধাগ্রস্থ হয় তখন আবেগের মৃত্যু ঘটিয়ে বিবেক জেগে উঠে। আচ্ছা ভাইয়া, মোবাইলের কী বাটন টিপতে টিপতে আঙ্গুলগুলো ক্লান্ত। তাই ফেসবুক থেকে বের হয়ে আমি আপনাকে কল দিচ্ছি।
-কল আমিই দিচ্ছি বলে কল সেন্ড করলাম।
মনি কল রিসিভ করে বললো, আঙ্গুলগুলো যেন ফুলে যাচ্ছে। এত টিপাটিপি করে চ্যাট করা খুবই কষ্ট।
-শোনেন, জীবনে চলার পথে আমরা অনেকেরই প্রেমে পড়ে যাই কিন্তু তাকে ভালোবাসা বলা চলে না। ভালোবাসায় অকৃত্তিম সুখ আছে, এ সুখটাকে অনন্তকাল ধরে রাখতে প্রয়োজন বিশ্বাস, ধৈর্য্য ও অপেক্ষা। কেউ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, কেউ হেঁটে চলে স্রোতস্বিনী নদীর ন্যায়- হৃদয়কে অপেক্ষার লকাপে বন্দি করে । অপেক্ষারও সীমা থাকে। অপেক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে গেলে এক সময় হৃদয়টাকে রদবদল করে নেওয়া ভাল।
-হৃদয় রদবদল কার সাথে করবো ভাইয়া, সবাই তো শয়তান। ভাল বিশ্বাসী, আস্থাভাজন সুন্দর হৃদয়ের কোন ছেলেই দেখছি না। আপনার মত একজন ভাল হৃদয়ের ছেলে পেলে আমি তাকে ভালবেসে জীবন সঙ্গী করে কাটিয়ে দেব অনন্তকাল !
-তাই ! আমার মত ছেলেরা আপনার মত মেয়েদের প্রেমে জড়াতে ভয় করে যে ?
-কেন ? আমি খারাপ মেয়ে ?
-খারাপ বলছি না, আপনি সুন্দরী ও মিষ্টি মেয়ে বলে কথা ! সব মানুষই টক ফল গাছে ঢিল ছোঁড়ে না, ঢিল ছোঁড়ে মিষ্টি ফল গাছে।
-কথা দিলাম, হাজারো ঢিল ছোঁড়েও আমাকে কেউ টলাতে পারবে না।
-আপনার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের সেই শয়তানটা যদি আবার লকাপ ভেঙ্গে আপনার হৃদয়টাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে তখন আপনি বিজয়ের উল্লাসে যদি হারিয়ে যান ?
-লকাপ ভাঙ্গার আগেই আমি তাকে ব্লক করে দেব। আপনার স্বত:স্ফুর্ত ও ষ্পষ্ট কথায় আমি প্রাণবন্ত অনুপ্রাণ খুঁজে পেলাম।
-আমি সব সময় স্পষ্ট কথাই বলি। এতে কেউ কষ্ট পেল কিনা তা আমি ভাবি না।
-স্পষ্টবাদীরা ভাল মনের অধিকারী হয়। অষ্পষ্টবাদীরা মুখে মিষ্টি কথা বলে কিন্তু অন্তরে বিষ লুকিয়ে রাখে যা এক সময় বিস্ফোরণ ঘটায়।
-আপনাকে একটা কথা বলে রাখি, আমি অন্যের জিনিষ নিয়ে টানাটানি একদম পছন্দ করি না। তাছাড়া আমি ছ্যাকামাইসিন ক্যাপস্যুল খাইতেও চাই না। যদিও ছ্যাকামাইসিনের সৃষ্টি আদি কাল থেকে।
-কোথায় থেকে পেয়ে থাকেন এত সুন্দর কথা, আমি চিন্তা করে কুল কিনারা পাইনা। কথার মেশিনে শুধু একবার স্টার্ট দিয়ে দিলেই কেল্লাফত ! আপনার কথাগুলো অমর হয়ে থাকবে কোন গল্প অথবা উপন্যাসে !
-সুন্দরী মেয়েদের ভালবাসা হলো চলন্ত লোকাল বাস। এ বাস প্রতিদিন বেশ কয়েকটা স্টেশনে আসে আর যায়, যাত্রীরা পিছে পিছে দৌঁড়ায়। কেউ ধরতে পারে, কেউ পারে না।
-আপনি ছাড়া কোন যাত্রীকে আমি উঠাব না। গেট লক করে শুধু আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো।
-প্রমিজ ?
প্রমিজ, প্রমিজ ও প্রমিজ। আমি গেট লক খুলে দিচ্ছি, আপনি চোখ বন্ধ করে দ্রুত উঠে পড়ুন।
-উঠলাম।
-গেট লক করে দিলাম। এ গেট আর কখনো খোলা হবে না। এ গাড়ি শুধু তোমার। সরি তুমি বলে ফেললাম !
-হৃদয়ের গাড়ির চালক তার যাত্রীকে তুমিই বলে। যাত্রীও তার চালককে তুমি বলে। আমিও আজ থেকে তুমিই বলবো।
-ধন্যবাদ তোমাকে।
-তোমাকেও ধন্যবাদ মনি। আমাদের ভালোবাসা যেন ওয়ান টাইম কফি ব্লেন্ড না হয়।
-বুঝলাম না !
-আমাদের ভালবাসাটা এমন না হয় যেন, প্রথম চুমুকে আহা স্মোকি হট তৃপ্তি, তিন চুমুকেই মজা শেষ। এরপর ছুঁড়ে কাপটি কফিসহ দূরে নিক্ষেপ।
-এমন হওয়ার কল্পনা আমি কখনো করবো না। তোমার প্রেরণা ও ভালবাসায় আমি যেন আমৃত্যু উদ্বেলিত হই এটাই কামনা করছি।
-আচ্ছা মনি, একটা কথা বলবো, মাইন্ড করবে না তো ?
-বল, মাইন্ড করব না।
-আমি যে গত দু’মাস থেকে নীল মনি নামে একটা আইডি’র মেয়েকে ভালবাসি। তাকে ছেড়ে আসবো কীভাবে ?
-নীল মনি ? আমারই তো আইডি নীল মনি। তোমার আইডি’র নাম কি লাল চোখ ?
-মানুষ এক ঢিলে দুই পাখী শিকার করে, আর আমি দুই ঢিলে এক পাখী শিকার করেছি।
-তাই ! পাখীটার নাম জানতে পারি ?
-তুমি ভেবে চিন্তে বের কর পাখীটা কে হতে পারে। ঠিক আছে প্রিয়া, আজ এ পর্যন্ত থাক, কাল কথা হবে।