শারমিনের গল্প : একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথন (পর্ব-১৬)
ভাবনাগুলো কখনো স্থির ছিলো না।সময় না মেপে একেকবার একেক সময়ে ছুটোছুটি করছিলো।অনেকটা আকাশে মেঘের লুকোচুরি খেলার মতো।এইতো চোখের সামনেই আমি দেখছি,ছোট্ট আমি গোলাপি ফ্রগ গায়ে দিয়ে আমারই সমান বিশাল এক পুতুলকে কোলে নিয়ে উঠানময় ছুটাছুটি করছি।একটা কথা চুপিচুপি বলে নিই।ছোট বেলায় গোলাপি আর লাল ড্রেসই আমাকে বেশি পড়তে হয়েছে। সবাই কেন জানিনা আমার জন্য সাধারণত এই দুই কালারের ড্রেসই কিনতো।এই পুতুলটি আমার ভীষণ প্রিয়।ঘুমের সময়ও কাছছাড়া করিনা।শুনেছিলাম, আমি হওয়ার খবর পেয়ে বড়মামা জামা,ক্লথ আর এই পুতুলটি নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন।তখন থেকেই পুতুলটি আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলো।সমস্যা শুধু একজায়গাতেই ছিলো।বড্ডা(আব্বার দাদি,যদিও আব্বারা সবাই দাদিকে দাদা বলেই সম্বোধন করতেন। ) পুতুলটি দেখলেই গজগজ করতে করতে পুকুরে নেমে যেতেন ওযু করার জন্য।উনি মনে করতেন, পুতুল দেখলে ওযু ভেঙ্গে যায়।উনার সরল মনে ধারণাটা এমন অদ্ভুত ভাবে পোক্ত হয়ে বসেছিলো যে কেউ তা থেকে একচুল নড়াতে পারেননি।তো এমনি এক বিকালে পুতুল নিয়ে উঠানে ছুটাছুটি করছি মনের আনন্দে।চার বছরের একটা বাচ্চার খেয়ালের বয়স তখনো হয়নি,তাই হয়তো দেখতেই পায়নি বড্ডা আছরের নামাজ পড়ার জন্য ওযু করতে পুকুরের ঘাটে যাচ্ছেন আর ওযু শেষে উপরে উঠেই পুতুল দর্শনে নতুন করে ওযু করতে পুকুরে নেমে যাচ্ছেন।শুকনো মৌসুম হওয়ায় পানি তখন পুকরের তলদেশে ছিলো।বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর এতটা দখল নিতে পারছিলো না।তবু তিনি অবিরাম ওযুই করে যাচ্ছিলেন। আর এভাবেই ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।দাদু আর আম্মা যখন বিষয়টা খেয়াল করলেন তখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।এতোবার ওযু করার পর বড্ডার মেজাজ তখন তুঙ্গে ছিলো।তাই দাদুও হয়তো এতোটা নিতে পারছিলেন না।একছুটে আমার কাছে এসে পুতুলটা নিয়ে গনগনে আগুন জ্বলা লাকরির চুলায় ফেলে দিলেন।এভাবেই আমার প্রিয় পুতুলটির সলীল সমাধি রচিত হলো।সত্যিই কী সলীল সমাধি হয়েছিলো?কই আজোতো আকাশের কোলে তাকিয়ে পুতুলটিকে ঠিকই অনুভব করছি।সেতো আমার কাছ থেকে কখনোই হারিয়ে যাইনি। পূর্ণিমার আলোয় যখন দ্বীপ হাতিয়া ভেসে যেতো তখন আমাদের বাতানখালির বাড়ির উঠানে বড় একটা চৌকি বের করা হতো।সেই চৌকিতে হুজানদাদু(আব্বাদের ফুফু) আয়েশ করে বসতেন।আর আমরা ছোটরা উনার চারপাশে গিজিগিজি করে বসতাম।হুজানদাদুর ছিলো রূপকথার রাজকন্যাদের মতো কাসকেড চুল আর দুধে আলতা গায়ের রঙ।এতোটা বয়সেও রূপের চ্ছটা একফোঁটাও কমেনি।বিশেষ করে চাঁদের আলোয় উনাকে দেখলে মনেহতো রূপকথার দেশ থেকেই ভুল করে আমাদের গল্প শোনাতে চলে এসেছেন।আর এমন মোহনীয় আয়েশি ভঙ্গীমায় গল্প বলা শুরু করতেন যে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।যখন গল্পগুলো টার্নিং পয়েন্টে যেতো তখন হঠাৎ চুপ করে যেতেন।আমরা যখন শোনার জন্য অস্থির হয়ে উঠতাম তখন আবার নতুন করে গল্পের মোড় ঘোরাতেন।গল্পের ভিতরের গীতগুলো ও উনি মধুর সুরে গেয়ে শোনাতেন।’বারো হাত কাঁকুড়ের তেরোহাত বিচি ‘র কাহিনী যখন শোনাচ্ছিলেন মনে হচ্ছিলো উনি প্রতিটি ঘটনারই প্রত্যক্ষ দর্শী। এতোটাই জীবন্ত ছিলো রূপকথাগুলো।গল্প বলা শেষে বাড়ির বড়রা চৌকি দখল করতো আড্ডা দেয়ার জন্য আর আমরা ছোটরা চাঁদ আর গাছদের মিষ্টি আলো-ছায়ার আঁধারীতে বৌচি,লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠতাম।আর অমাবস্যার দিনগুলোতে আমরা ঘরের ভিতরে দাদাভাইকে(আব্বাদের চাচা) ঘিরে বসতাম।দাদাভাই আমাদের বিভিন্ন শোলক(ধাঁধাঁ) ধরতেন,খনার বচনগুলো শোনাতেন,আমাদের পূর্বপুরুষদের গল্প ও শোনাতেন।দাদাভাই যৌথপরিবারের প্রত্যেকের জন্ম তারিখ,উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী লিখে রাখতেন।আমরা ছোট বলে অবহেলা না করে সেসব আমাদের দেখতে দিতেন এবং ধৈর্য্যসহকারে যে কোন জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন।তবে সবচেয়ে বেশি জ্বালাতন করতাম আমরা হুজানদাদুকেই।এজন্য অবশ্য উনার গল্পের ভাণ্ডারই দায়ী ছিলো। উনার ছোটবেলার কাহিনীগুলো শুনতেও ভীষণ ভালো লাগতো আমাদের। বিশেষ করে যক্ষের গল্পটি প্রায় শুনতে চাইতাম। পানির দেশের মেয়ে হয়েও হুজানদাদু কখনো পুকুরে নামতেন না।ওনার মাঝে একধরনের অজানা ভয় কাজ করতো।উনি ভাবতেন, পুকুরে নামলেই যক্ষ এসে উনার পায়ের কড়ে আঙ্গুলে শিকল পড়িয়ে দিবে।এই ভয়ের বীজ উনার মনে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই গ্রথিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে তা মহীরুহে পরিণত হয়েছিলো।ছোট্ট বেলায় আমাদের পুরাতন বাড়ির পুকুরের পানির কাছে গেলেই অদৃশ্য কেউ নাকি উনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো।অন্য কেউ তা দেখতে পেতোনা।আবার ঘুমের মাঝে ও একই স্বপ্ন দেখে ঘেমে নেয়ে জেগে উঠতেন। তাই সবসময় পানির কাছ থেকে দূরে থাকতেন। এমনকি গোসলও করতেন তোলা পানিতে।যখন আমাদের পুরনো বাড়িটির কাছে নদী চলে এলো তখন একরাতে কেমন একধরনের শিকল টানা ঘর্ঘর আওয়াজ ভেসে এসেছিলো পুকুরের পাশটা থেকে। সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেলো থালার মতো বড় গোল কিছু একটা পুকুর পাড় থেকে নদী পর্যন্ত ঘষঁটে ঘষঁটে চলে গেছে।শুধু চিহ্নটুকুই পিছনে রয়ে গেছে। অসুস্থ অবস্থায় অন্য কারো কী হয় জানিনা, আমার সবসময় শুয়ে শুয়ে অপ্রয়োজনীয় বিক্ষিপ্ত অতিতুচ্ছ ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাই।সব সাধারণ ঘটনাবলীও নাটকের দৃশ্যের মতো দৃশ্যপট পাল্টায়।ঐতো স্পষ্ট কানে বাজছে,বড্ডা বাঘাকে বলছে,বাঘা তুই সুস্থ থাকতে কোন কষ্ট দিসনি,মরণকালে বুঝি কষ্ট না দিয়ে ছাড়বি না?ততক্ষণে বাঘার পিছনের পাদু’টো অবশ হওয়া শুরু হয়েছে।বাঘা উঠানে শুয়ে করুণ ছলো ছলো চোখে বড্ডার দিকে তাকালো।এরপর অবশ হওয়া শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে দুই জমিন পার করে তৃতীয় জমিনে গিয়ে মরে গেলো।সে কী দৃশ্য!নাটকের করুণদৃশ্যও বুঝি এ দৃশ্যের পাশে ম্লান হয়ে পড়ে।পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে ঘটনার আরেকটু পিছনে যেতে চাই।আমাদের বাতানখালীর বাড়িতে বড্ডা হাঁস,মুরগী,কুকুর পালতেন।তবে লালন-পালনের ক্ষেত্রে উনি খুব কঠোর ছিলেন।হাঁস- মুরগী কখনো ঘরে ঢুকতে পারবেনা,উঠানে টয়লেট করতে পারবেনা।নির্দিষ্ট স্থানে টয়লেট সারতে হবে,বাঘার(কুকুর) ক্ষেত্রে ছিলেন আরো বেশি কঠোর।এখন ভাবতেও অবাক লাগে পশু,পাখিরা উনাকে এতোটা মান্য করতো কেন? আহারে!বাঘাতো মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও উনার নির্দেশ অমান্য করেনি।তবে বাঘার জন্য উনার চোখেও পানি দেখেছি।চিরবিদায়ের আগ মুহূর্তে দুজনের চোখেই পানি দেখেছিলাম।যদিও তখন আমি নিতান্তই ছোট্ট শিশু। বুঝার মতো বয়স বা জ্ঞান কোনটাই আমার ছিলোনা। তবুওতো আজো ভুলিনি।