শারমিনের গল্প : একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথন (পর্ব-৪৫)
Thursday, November 10, 2022
শ্লোগানের সাথে গলা মেলানোর কথাটা পড়ে কেউ আবার আমাকে রাজনৈতিক বিষয়ে উৎসুক গোছের কিছু একটা ভেবে বসবেন না।এই জীবনে রাজনৈতিক বিষয়ে আমি বরাবরই উদাসীন ছিলাম।ঐ উদাসীনতাটুকু ড্যাডির কারণেই হয়তো আমার মনের মাঝে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিল। ড্যাডি সবসময় বলতো, সরকারি নিয়ম নীতি অনুযায়ী সরকারি অফিসারদের পছন্দের কোন দল থাকতে নেই। সেই উদাসীনতা থেকেই হয়তো আমিও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর কোন লেখা কখনো চোখে পড়লেও বেশির ভাগ সময় এড়িয়ে যেতাম। শুধু হিটলারকে নিয়ে লেখা কয়েকটি বই পড়েছিলাম। রাজনৈতিক বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে আমার এতো বেশি কৌতুহল কাজ করতো যে তুচ্ছ কাগজের ঠোঙাতে কী লেখা আছে তাও পড়ে ফেলতাম। তবে ৯০ সালটি সত্যিই ব্যতিক্রম ছিল।সেই সময়ে স্বাভাবিক পরিবেশে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল তার কিছু কিছু ধোঁয়াশা ভাবে আজো স্মৃতিতে রয়ে গেছে।ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অদম্য আগ্রহের কারণে সবসময় কল্পনায় নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে সাহসী যোদ্ধা হিসাবেই ভাবতে ভালোবাসতাম। যদিও বাস্তবে আমি এতটা সাহসী না।সেই দিনগুলোতে আমার কেন যেন মনে হতো, মুক্তি যুদ্ধের পরে জাতি মাঝে মধ্যে একটু নড়েচড়ে শোয়া ছাড়া বিশাল এক ঘুম দিয়ে ৯০-এর শেষ ভাগে এসেই যেন জেগে উঠেছিল।সেসময়ে রেডিও, টিভির বুলেটিন কেউ সাধারণত মিস করেনা।সাথেতো দৈনিক পত্রিকাগুলো আছেই।সবাই কানাঘুঁষা করছিল,গণমাধ্যমগুলো একাত্তরের মতো একনিষ্ঠ নয়।পঙ্কিলতার আগাছা এদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এমনকি ওদের চোখে মুখে নাকি ঠুলি পড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই জাবরকাটা ছাড়া আর কিছুই পারেনা। এখনই গা ঝাড়া দিয়ে জেগে না উঠলে আর কোনদিনই নাকি এই মাধ্যমগুলোর বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা করার উপায় থাকবেনা। ঠিক যখন সকল রাজনৈতিক দল এবং আপামর সাধারণ ছাত্র জনতা সবরকম বাধা বিপত্তিকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে এক মতাদর্শে উপনীত হয়েছিল তখন মিডিয়াও আড়মোড়া ভেঙে সকল আগাছা উপড়ে নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। টানটান উত্তেজনা নিয়ে সবাই নতুন দিনের প্রতিক্ষায় ছিল।আর আমাদের স্কুলের স্যারেরা চিন্তিত ছিলেন বার্ষিক পরীক্ষা আদৌ নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে।অবশেষে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলেন পরীক্ষাগুলো সকাল বিকাল দুই বেলা করে পর পর নিয়ে দ্রুতই শেষ করে ফেলবেন।কারণ, পরিস্থিতি কখন কোন দিকে গড়ায় তা নিয়ে স্যারেরা যথেষ্ট শঙ্কিত ছিলেন। স্যারেরা কেউ আর আগের মতো ক্লাসে মনোনিবেশ করতে পারেন না। নতুন যে বিজ্ঞানের শিক্ষক আমাদের স্কুলে জয়েন করার পর থেকে আমাদের ক্লাসের চেহারায় পাল্টে গিয়েছিল সেই প্রাণ রসে ভরপুর স্যার পর্যন্ত নির্জীব হয়ে গেছেন।অথচ এই স্যারের সহযোগিতায় সাধারণ মানের ছাত্রীরাও পড়াতে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। স্যার কী করে যেন ক্লাসের সবার মনের ভাবনাগুলো পড়ে ফেলে সবাইকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারতেন।
এভাবেই স্যার সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন।স্যারের একটা বিশেষ গুণ হল , স্যারের সাথে যে কোন বিষয়ে অসংকোচেই আলোচনা করা যেতো। তাই আমাদের মনের কোণে ‘সরকার হটাও’ বিষয়ক যে সকল জিজ্ঞাসা জেগে উঠতো তা স্যারকে জিজ্ঞাসা করেই নিরসন করতাম। তবে রাজনৈতিক বিষয়ে কোন উত্তর দেয়ার পূর্বে স্যার উঁকি মেরে ক্লাসের বাইরের দিকে ভালো করে দেখে নিতেন।প্রায় হরতাল ডাকা শুরু হলো তাই পরীক্ষা গোল্লায় উঠলো।কোন মতে এক বিষয়ের পরীক্ষা সমাপ্ত হলে আরেক বিষয়ের জন্য দশ/বারো দিন অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য পড়াশোনা করতে ও ভালো লাগতো না। সেই সময় ঢোল কলমি গাছে একধরনের জীবন সংহারক বিষাক্ত পোকার আক্রমণের কথা প্রায় পেপারে লেখা হতো।পড়তে ভালো লাগছিল না বিধায় বসে বসে ‘ঢোল কলমি’ শিরোনামে একটা কবিতা লিখে ফেলে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম।তারপর অতি গোপনে ঝর্ণাকে দেখালাম। ঝর্ণা এতটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো যে আমার নিষেধ অমান্য করে ক্লাসের সবাইকে দেখাল।সবাই যখন আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো তখন লজ্জায় আমি কোথায় মুখ লুকাবো সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম। বাসা থেকে পড়াশোনার উপর যে কড়াকড়িটুকু আরোপ হয়েছিল সেটা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে শিথিল হয়ে গেল। সেই সুযোগে আমি আর ঝর্ণা প্রতিবেশীর ডিভিডি প্লেয়ার বাসায় এনে উত্তম সুচিত্রার কয়েকটি ছবি খুব আনন্দের সাথে উপভোগ করলাম। কিন্তু সব আনন্দই নিরানন্দে পরিণত হলো যখন শুনলাম চট্টগ্রামেরই ছেলে ডাক্তার শামসুর রহমান মিলনকে পরিকল্পিত ভাবে টিএসসির সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।শহিদ মিলনের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। প্রজ্বলিত অগ্নিতে যেন ঘৃত হয়েই ছড়িয়ে পড়েছিলো ডাক্তার মিলন। তারই লেলিহান দাবালনের শিখায় পুরো দেশ যেন একসাথে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল।আর তারই প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল, ছাত্র,জনতা, আপামর জনসাধারণের চিন্তা ধারা ভোজবাজির মতো একসূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। সরকার ক্রমাগত কারফিউ দিয়ে ও আন্দোলন দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছিল। সেনাবাহিনী আর সংবাদ মাধ্যমগুলোও এক ছাতার তলে এসে প্রবেশ করল।সত্যনিষ্ট সংবাদ প্রচারে বাধা আসায় সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে আমাদের দামাল ছেলেরা কয়েক দিন সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থেকেছিলেন। সেসময় প্রথম অনুভব করতে পেরেছিলাম কী করে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলাম।তখন আমাদের দেশটা অনেকটা, দশের লাঠি একের বলের মতোই বলীয়ান হয়ে গিয়েছিল। তাই বিজয়ের দিন যে খুব একটা দূরে নেই সেটুকু সবাই অনুভব করতে পারছিল। পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়ানোর জন্য যে এই জাতির জন্ম হয়নি তা সরকার ও উপলব্ধি করতে পারলেন। একতাবদ্ধ জনতার জোয়ারে খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার পূর্বেই সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন সরে দাঁড়াবেন। সেই দিনটিতে পুরো দেশ উৎসবে ভেসে গিয়েছিল। জানিনা, সেই দিনটিতে ডাক্তার মিলনের মায়ের মনের কী করুণ দশা হয়েছিলো? সবাই নতুন আগামীর দিশা খুঁজে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠার মুহূর্তে ছেলে হারা মায়ের যাতনা কী একটি বারের জন্য ভেবে চোখের পানিতে আপ্লূত হয়েছিল? কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানায় থেকে যায়। ঈদ বা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিন যেভাবে সারাদিন ব্যাপী বিটিভিতে অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হতো, ঠিক সেভাবেই সেদিনও সকাল থেকেই টিভিতে নানা অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছিল। আমি টিভি অন করতেই ‘দি ফাদার’ সিনেমাটি শুরু হল।এই সিনেমাটি দেখার আগ্রহ আগে থেকেই ছিল।মামনি ছোট বেলায় ‘আয় খুকু আয়’ গানটি গেয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতো। তখনই একদিন মামনির কাছে এই সিনেমাটির কথা শুনেছিলাম।আমি মনের আনন্দে সিনেমাটি দেখতে বসে গেলাম। আর মামনি উৎসব মুখর পরিবেশকে অনবদ্য করে তোলার অভিপ্রায়ে স্পেশাল রান্নাবান্না করতে নীচতলার রান্নাঘরে চলে গেল। দিনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই সামনের দিকে ছুটে চলে আপন গতিতে। ঐ সময় চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকে স্বল্প পরিসরে চিড়িয়াখানা তৈরি হচ্ছিল। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা একদিন পাহাড়তলীতে ড্যাডির বন্ধু কাজীমামাদের বাসায় গেলাম। ওখান থেকে উনারা সহ ফয়েজ লেকে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফয়েজ লেকে অবস্থিত চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখার সময় ড্যাডি সিদ্ধান্ত নিলো, আমাদের অতি আদরের মিঠু, মন্টি, ঘণ্টিকে (হরিণের নাম) চিড়িয়াখানায় দান করে দিবে। কারণ, বন্য প্রাণী লালনপালনের ক্ষেত্রে সরকারি কিছু বিধি নিষেধ আছে। তাই মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ড্যাডির পক্ষে এই সিদ্ধান্তটি নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। তখনই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ড্যাডি কথা ফাইনাল করে ফেলেন। এরপর আবার ও বিদায়ের পালা। তবে এবারের বিদায় আমাদের সাথে অবলা জীবের।প্রিয় মিঠু, মন্টি, ঘন্টিকে বিদায় জানাতে আমাদের বুকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল। ওরাও কিছু একটা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিল।তাইতো নেয়ার সময় বারবার পিছু ফিরে সুন্দর মায়াবী চোখগুলোকে আরো মায়াময়ী করে তুলে নিরব বাণীতে কতো মিনতিই না করে গেল। চিড়িয়াখানার বন্দী জীবনে ওরা হাঁসফাঁস করবেনাতো? এখানকার স্বাধীন জীবনের আনন্দময় স্মৃতিগুলো কী ওদের স্মৃতিতে থেকে যাবে?চিড়িয়াখানার চারদেয়ালের ভিতরে ওরা কী নতুন কোন বন্ধুর দেখা পাবে? নাকি আমাদের কথা ভেবে উদাস নয়নে হাপুসহুপুস করবে? এখানে থাকাকালীন সময়ে খাবার পছন্দের বিষয়ে ওরা খুব নাক উঁচু টাইপের ছিল। ওখানে ওদের সেই আবদারের ভাষা কী কেউ বুঝতে পারবে? ওরা ভীষণ আদরের কাঙ্গাল ছিলো।
আদর করে গলায় হাত বুলিয়ে দিলেই ওরা লম্ফঝম্ফ বাদ দিয়ে আবেশে চোখ বুজে ফেলত।খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম সেদিনটিতে।তবু জীবনের তাগিদে মানুষকে ভাবাবেগ দমন করে কখনো কখনো বিদায় নিতে হয় আবার কখনো বা বিদায় দিতে হয়।শুধু এই সত্যটুকু মেনে নিতে বুকে অনেক সময় পাষাণ পাথর বাঁধতে হয়। বিধাতার কাছে এটুকুই চাওয়া ওরা যেন সবসময় ভালো থাকে। এরপর আমি হাতিয়ায় চলে গিয়ে এ,এম, হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। হাতিয়াতে থাকলে যেরকম শান্তি পাই, সেরকম শান্তি আমি বোধহয় দ্বিতীয় কোন স্থানেই পাবোনা। হাতিয়ার প্রতি আমার এই সহজাত আকর্ষণ অনেকটা প্রলোভনের মতোই।আমার প্রায় মনে হয়, হাতিয়ার মাটির নিজস্ব আকর্ষণ ক্ষমতা আছে। তাই যতো দূরেই এর অধিবাসীরা থাকুক না কেন, অদৃশ্য সুতোর মোহময়ী টান ঠিকই অনুভব করতে পারে। হাতিয়ায় যাওয়ার পর থেকে প্রায় দিন পুকুরে বরশী দিয়ে মাছ ধরতাম। আবার ভোরে উঠে আবছা আলোতে পুকুরের চারপাশে হেঁটে হেঁটে গলদা চিংড়ি খুঁজতাম।রাতে চিংড়িগুলো দুপাশে শুঁড় ছড়িয়ে কূল ঘেঁষে ঘুমাতো। সেই চিংড়িগুলোর মাথা চেপে ধরলে সেগুলো আর নড়াচড়া করতে পারতোনা।চিংড়ি কথন সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার আগে আরো কিছু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন।না হলে পাঠকেরা ঠিকভাবে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেনা। আব্বা সেসময় নোয়াখালীতে সোনালী ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চে ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ওখান থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে এসে আবার শনিবারে কর্মস্থলে চলে যেতেন। কিন্তু কখনো দুর্যোগ পূর্ণ আবহাওয়া দেখলেই আব্বা হাতিয়ায় না এসে ঘাট থেকেই ফিরে যেতেন।এর অন্যথা হতো না।উনার মনের এই সুপ্ত ভয়ের একটা কারণ সুদূর অতীতেই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল।উনি একবার ঝড় ঝঞ্ঝার মাঝেই সীট্রাকে করে হাতিয়াতে ফিরছিলেন।মাঝ দরিয়াতে প্রবল বাতাস আর স্রোতের মিলিত শক্তির কাছে হার মেনে সীট্রাক দিক হারিয়ে ভেসে গিয়েছিল। শুধু কী তাই? সীট্রাকের ভয়াবহ ঝাঁকুনিতে যাত্রীরা ভারসাম্য হারিয়ে সবাই কম বেশি দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিল। আব্বা যখন রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন তখন কান্নার রোল বয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার এসে আক্রান্ত স্থানগুলো ড্রেসিং করে বেন্ডেজ করে দিয়েছিলেন। ঐ ঘটনার পর থেকেই আব্বা দুর্যোগ পূর্ণ আবহাওয়া দেখলেই ফিরে যেতেন।এমনও দিন গেছে আব্বা দুই/ তিন সপ্তাহ বাড়িতে না এসে ঘাট থেকেই ফিরে গিয়েছেন।এই রকম সময়গুলোতে আম্মার পক্ষে সংসার চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে যেতো। একবার এরকম দুঃসময়ে ভোরবেলায় খালি হাতে ধরা চৌদ্দটা বড় গলদা চিংড়ি ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, বিদেশি জাহাজগুলো যেখানে নোঙর ফেলেছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে।লাফানো চিংড়িগুলো ওদের চোখে পড়লে ঠিকই কিনে নিবে। সত্যি সত্যিই সেই চিংড়িগুলোকে ভাইয়া সাড়ে তিনশো টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে পেরেছিল।চৌদ্দটি চিংড়ির মোট ওজন সাড়ে তিন কেজির মতো হয়েছিল। এর পূর্বে আমরা কখনো পুকুরের মাছ বিক্রির কথা কখনো কল্পনাও করিনি।আম্মা মাছগুলো সবাইকে বিলিয়ে খেতেই বেশি পছন্দ করতেন। তবে সেদিন আমি আর ভাইয়া মিলে আম্মাকে যখন মাছ বিক্রির টাকা দিলাম তখন আম্মার চোখের কোণে পানি দেখতে পেয়েছিলাম। আমাদের ছোটবেলায় আব্বা যখন একবার এরকম পরিস্থিতিতে বাড়িতে আসতে পারছিলেন না তখন আম্মা কয়েক দিন সকালে শুধু ভাত, ডাল আর সজনে পাতার ভর্তা দিয়ে খেতে দিয়েছিলেন।অবশ্য কখনো কখনো সেই খাবারগুলোর সাথে একটি ডিমকে পিঁয়াজ, মরিচ দিয়ে ভেজে চার টুকরো করে ও আমাদের পাতে দিতেন।তবে যেদিন সকালে শুধু সজনে পাতার ভর্তা দিয়ে খেতে দিতেন সেদিন গলা থেকে খাবারগুলো উগরে আসতে চাইলেও না গিলে কোন উপায় থাকতো না। আম্মা বিভীষণের মতো যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে চুঙ্গা(মাটির চুলাতে ফু দিয়ে আগুনের আঁচ বাড়াতে চুঙ্গা ব্যবহৃত হতো) উঁচিয়ে আমাদের সম্মুখেই বসে থাকতেন।আমরা খাওয়া নিয়ে কোন রকম ত্যাদোড়ব্যাদোড় করলেই নাকি সেই চুঙ্গাখানা আমাদের পিঠের উপর সপাট বেগে পড়বে। আমাদেরকে কখনোই মারা লাগতো না। তার আগেই চোখমুখ কুঁচকে খেয়ে নিতাম। আম্মা এতোটাই নিরীহ কিসিমের ছিলেন যে আমার মনে হয়, আমরা নির্দেশ মতো না খেলেও আম্মা আমাদের গায়ে ফুলের টোকাটুকুও না দিয়ে উল্টো ভোঁসভোঁস করে কেঁদে ভাসাতেন। ঠিক ঐ সময়ে একদিন ভাইয়াকে সফুরা ফুফুদের বাড়িতে দাওয়াত দিল। সফুরা ফুফু হলেন হুজানদাদুর ছোট মেয়ে।হুজানদাদুর কোন ছেলে না থাকায় আব্বারা ফুফাতো বোনদের কাছে ভাই হয়ে উঠেছিলেন। যাইহোক, ভাইয়া দুপুরে যথাসময়ে ঐ বাড়িতে উপস্থিত হয়ে যখন খেতে বসল তখন ভাইয়ার পাতে মুরগির রান(লেগ পিছ) তুলে দিতে দিতে সফুরা ফুফুর শাশুড়ী কথাচ্ছলে জানতে চাইলেন, সকালে কী দিয়ে খেয়েছ?এমনিতেই হাতিয়াতে গ্রাম সাইডের দিকে কেউ কারো সাথে সাক্ষাৎ হলেই কমন প্রশ্ন থাকতো, কী দিয়ে খেলে?ভাইয়া এই সাধারণ প্রশ্নটি শুনে ক্ষোভ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ফেলল, আমাদেরকে আম্মা প্রতিদিন সকালে শুধু সজিনা পাতার ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেয়। না খেতে চাইলেই আম্মা চুঙ্গা উঁচিয়ে আমাদেরকে ভয় দেখায়।তাই খাওয়া ছাড়া কোন উপায়ও থাকেনা।ওদিকে সফুরা ফুফু যতই চোখের ইশারায় ভাইয়াকে থামার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল ততই প্রেস্টিজ ফাংচার করে ভাইয়া আরো স্প্রীডেই বলে যাচ্ছিল।