শারমিনের গল্প : একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথন (পর্ব-৪৮)
Monday, November 14, 2022
.
স্মৃতিরা মাথার মাঝে অবিরত এভাবেই অনুরণিত হয়ে এক ঘটনা থেকে অবলীলায় অন্য কোন ঘটনায় অবাধে প্রবেশ করে। সেখানে কলকাঠি নেড়ে এদিক সেদিক না করে আমিও স্মৃতির পিছু পিছু ছুটে চলি।ঐতো আমার আর মান্নার অপেক্ষার প্রহরকে আনন্দে ভরিয়ে দিতে আব্বা গেট দিয়ে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বড়সড় একটা কাঠের কার্টুনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে ভিতরে ঢুকছেন। ঋজু গড়নের লম্বা কিসিমে’র হওয়ায় আব্বাকে গেট দিয়ে একটু ঝুঁকেই প্রবেশ করতে হতো নতুবা গেটের উপরের অংশের সাথে ঠুস খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যেত। ঐ কার্টুন দেখা অব্দি আমাদের কৌতুহল আর ফিসফিসানির কোন সীমা পরিসীমা ছিল না। আব্বা বাক্স রহস্যের জট না খুলেই আমাদেরকে অধিক আগ্রহে ভাসিয়ে দিয়ে ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে গোসল করতে পুকুরে নেমে গেলেন।আমরা ভাবলাম, আব্বা হয়তোবা বাক্স বন্দি করে জাদুর কোন উপকরণই নিয়ে এসেছেন।আমাদেরকে রহস্যময় কোন জাদুর খেল দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিবেন। এমনিতেই নোয়াখালীতে বদলি হওয়া অব্দি আব্বা নাকি অনেক রাত পর্যন্ত অফিস করেন। এরপর সময় কাটানোর জন্য একা একাই বিভিন্ন জাদু শিখে সহকর্মী, পরিচিত জনদের দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। আবার বাড়িতে এলেই রাতের বেলা আমাদেরকে জাদু শুধু দেখাতেনই না, শেখাতেন ও।জাদু গুলোর মাঝে তাস আর অঙ্কের জাদু গুলোয় আমাকে বেশি আকৃষ্ট করতো। আমরাও রসায়নের বই ঘেঁটে দু’ চারটে জাদু শিখে রাখতাম আব্বাকে দেখিয়ে অবাক করে দেয়ার জন্য। সেই জাদুগুলো দেখে আব্বা এতো খুশি হতেন যে মনেহতো তাঁর মেয়েদের গুণের কোন সীমা নেই। জাদু পর্ব শেষ হলেই আব্বা জোলা আর জুলুনির গল্প বলা শুরু করতেন।পাঠকদের কেউ কেউ ভাবতে পারেন একই গল্প মানুষ এতবার শুনে কী করে? তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, যখন কেউ ভালোবেসে কিছুর বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটায় সেটা শুনতে কখনোই পুরান লাগে না।প্রতিবারই নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। না হলে আমি আর মান্না কী করে এতো আগ্রহ করে শুনে যেতাম?
বিশেষ করে জোলা যখন প্রতিবার বিপদে পড়ে জুলুনিকে বেদম পিটুনি দিয়ে নিজেও আত্মঘাতী হতে যেতো সেই বর্ণনাগুলো এতোটাই প্রাণবন্ত হতো যে আমরা হেসে কুটি কুটি হতাম। তাছাড়া মাঝে মাঝেই গল্পের একঘেয়েমীত্ব কাটানোর জন্য আব্বা উনার ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে কী কী খুনসুটি করতেন সেই গল্পগুলোও বলতেন। বন্ধুদের নিয়ে করা একটি গল্প এতো ভালো লাগতো যে গল্পটি বলার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। আব্বারা একের বন্ধু তখন একেক কলেজে লেখাপড়া করতেন। আব্বা ঢাকায় গিয়ে ঢাকা কলেজে শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে একই ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলেন। কথাটা আব্বার মুখে প্রায় শুনতাম। যাইহোক, ছুটিতে সব বন্ধুরা বাড়িতে এলে সবাই মিলে অনেক মজা করতেন। এমনই কোন এক শীতের বিকেলে আব্বারা ঠিক করলেন, সবাই মিলে হাঁস রান্না করে খাবেন। কথা অনুযায়ী কার্য সম্পাদনে বিলম্ব হলো না। অপটু হাতগুলো যখন হাঁসের পালক ছাড়াতে গেল ঠিক তখনই বিপত্তি দেখা দিলো। হাঁসগুলোর সারা শরীরে চোরা পালকে ভরপুর। এদিকে চামড়া বিনা হাঁস খাওয়া, না খাওয়ারই নামান্তর। তাই কোনরকমে পরিষ্কার করে হাঁস ধুয়ে ইট বিছিয়ে তৈরি করা চুলোয় চড়িয়ে পাটখড়ি দিয়ে জ্বাল দিতে লাগলেন সবাই মিলে। কিছুক্ষণ পরে ঢাকনা সরিয়ে মাংসগুলো নেড়ে দেয়ার সময় সবাই দেখেন ছোট ছোট পালকগুলো চামড়া ভেদ করে অঙ্কুরোদগম হয়ে ওদের দিকেই যেন চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে। রান্না শেষে খেতে বসে সবাই আনমনে চিন্তা করছিল, কী করে চোখে দেখে এটা আহার করবেন? এদিকে না খেলেও এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে তা নিয়ে ক্ষেপাতে পারে। ঠিক সেই মুহূর্তে আব্বার বন্ধু মঞ্জুকাকা(আমার বন্ধু জলির আব্বা) লাইটের সুইচ অফ করে দিয়ে সবাইকে বললেন, নো টেনশন ডু ফুর্তি। তোরা আর মুখখানাকে প্যাঁচার মতো করে না রেখে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। তোরা সবাই মনে মনে ভেবে নে, এই রুমে কারেন্ট ও নেই, আবার কোন আলো জ্বালানোর ব্যবস্থাও নেই। তাই অন্ধকারে হাঁসের গোসত খাওয়ার সময় বিদঘুটে পালকগুলোকে চোখে না দেখে প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করতে আমাদের বাধা কোথায়?সবাই কথাটা শুনে গোগ্রাসে মজা করে খাওয়া শুরু করলেন। হাপুসহুপুস খুটখাট আওয়াজে তা ভালোভাবেই বোধগম্য হচ্ছিল। আব্বার আরেক বন্ধু নাজিমকাকা(আমার বন্ধু শর্মির আব্বা) বলে উঠলেন,আহ!খেতে যে এতো মজা হয়েছে তা লাইট জ্বালানো থাকলে কোনভাবেই বুঝতে পারতাম না রে। আসলে বুঝলিনা, কষ্মিন দেশে যদাচার।সব চিন্তার জাল চিহ্ন করে অবশেষে আব্বা এসে যখন কৌতুহল নিরসন করতে বাক্সের সামনে দাঁড়ালেন ততক্ষণে উৎসুক জনতার মোটামুটি ঢল নেমেছে। সুলতু, আমি আর জলি ফিসফিসানী থামিয়ে কী ঘটতে চলেছে তা বুঝার চেষ্টা করছি।আব্বা সবকিছুতেই রহস্য করতে ভালোবাসেন। লেকচারের ভঙ্গিতে বলা শুরু করলেন, এই বাক্সে আমাদের উপকারী বন্ধুরা আছে।ঃ কোন বন্ধু? কোন বন্ধু? গুঞ্জন উঠলো। এটা কোন ঠুনকো বাক্স না,এটা হলো গিয়ে একঝাঁক মৌমাছির বাসা।এখন তোমাদেরকে আমি বাক্সটির মুখ খুলে দেখাব। আমরা অতি বিস্ময়ে ক্ষুদে ধরনের একপ্রকার মৌমাছি দেখলাম।এর আগে আমাদের বাতানখালীর বাড়ির গাছে মৌচাক দেখেছিলাম। সেগুলো সাইজে অনেক বড় ছিল। এই প্রথম বাক্স বন্দি মৌমাছি দেখলাম। আব্বা বলে যেতে লাগলেন, এখন থেকে তোমরাই মিলেমিশে মৌমাছিগুলোকে দেখেশুনে রাখবে।এরাই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে আমাদের জন্য সংরক্ষণ করবে। এখন থেকে আর ভেজাল মধু খেতে হবে না। এরপরে বারান্দায় চেয়ার পেতে বাক্সটা সেট করে চিনির সিরাপ তৈরি করে মৌমাছিদের খেতে দিলেন।মৌমাছিগুলোকে নিয়ে আমাদের সময় ভালোই কেটে যেতে লাগলো। অবসরে এদের গতিবিধি জরিপ করতে বেশ লাগতো। তাছাড়া মৌমাছিদের জীবনযাত্রা সংক্রান্ত কয়েকটি বই জোগাড় করে পড়ে ফেলেছিলাম। আমি আর জলি একটু বেশিই কৌতুহলী হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বাড়িতে এলে আমি আর আব্বা মিলে মধু সংরক্ষণ করতাম। মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছির অহেতুক যন্ত্রণাদায়ক কামড়ানির হাত থেকে বাঁচার জন্য বাক্স থেকে ট্রেগুলো বের করার সময় সিগারেটের ধোঁয়া বেশ কাজে দিত। আব্বা ধোঁয়ার কুন্ডলি ছড়িয়ে ট্রে বের করে একটা বলে (ছড়ানো পেয়ালায়) এমনভাবে বসাতেন যে ওটা নট নড়নচড়ন অবস্থায় তাতে আটকে যেতো।
অতপর পেয়ালাটি বা ডিস্কো টাইপের কড়াইটিকে চিক্কার ভিতরে ঢুকিয়ে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে সমবেগে ঘুরাতেন।ঘূর্ণনের ফলে মধুগুলো একটুও স্থান চ্যুত না হয়ে বলে জমা হতো। সেই মধু কাঁচের বৈয়ামে সংরক্ষণ করে আব্বা ভাই, বোন,আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে অনেক আনন্দ নিয়ে বিতরণ করতেন। ঐ মধু যারা খেয়েছিল, আমার ধারণা তারা এই জীবনে আর কোন মধু তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারবেনা। কারণ, আসল নকলের তারতম্য বুঝার রহস্য ততক্ষণে জিহবাগুলো রপ্ত করে ফেলেছিল।আমি আর জলি রীতিমতো মিটিং করে ঠিক করে ফেললাম, আমরা দুজন মিলে ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে মৌমাছির চাষ করব। তাহলে সাধারণ আপামর জনতাও প্রকৃত মধুর স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে। আপাতত স্বল্প পরিসরে শুরু করে স্বপ্নটাকে বহুদূর পর্যন্ত টেনে নেয়ার ইচ্ছে ছিল। তাই জলি আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রাথমিক ভাবে দুই হাজার টাকা দিয়ে শুভ যাত্রা শুরু করবো। সবচেয়ে বড় মুসিবতের ব্যাপার হলো , আমাদের দুজনের কারো কাছেই কোন টাকা নেই। বড়কাকা আমাকে মাসিক মাসোহারা বাবদ যে দুইশত করে টাকা দেন তার বেশিরভাগ খরচ হয়ে যায় সেবা প্রকাশনী থেকে ডাক মারফত বই কিনতে গিয়ে। আর বাকি কিছু অবশিষ্ট থাকলে তাও কেউ বিপদে আছে শুনলেই দিয়ে ফেলি।তাই টাকা জোগাড়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লাম। সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বড় কাকার কাছে চিঠি লিখতে শুয়ে গেলাম। আমি সবসময় শুয়ে শুয়ে চিঠি লিখতে ভালো বাসতাম। চিঠিতে সব বৃত্তান্ত জানিয়ে পত্র পাঠ মাত্রই যেন আমার জন্য একহাজার টাকা পাঠিয়ে দেন সেই বিষয়ে সনির্বদ্ধ অনুরোধ করলাম। এদিকে ঠিক সেই সময়ে বড় খালাম্মা আমাদের বাড়িতে মাস খানেকের জন্য বেড়াতে এসেছিলেন। আগেই লিখেছিলাম অপার সৌন্দর্যের পাহাড়ি এলাকা চট্টগ্রামের লামায় বড় খালাম্মার শ্বশুর বাড়ি।বড় খালাম্মার সাথে কালে ভদ্রে দেখা হলেও উনার অতি নরম স্বভাবের জন্যই হয়তো কেমন মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যেতাম। সবাইকে ভালোবেসে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল বড় খালাম্মার।উনার এই গুণটি আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করতো। বড় খালাম্মা আসায় বাড়িতে প্রতিদিনই ভালো মন্দ রান্না হচ্ছিল। আম্মা আর দাদু প্রতিদিনই নতুন কোন পিঠা পুলি তৈরি করছিলেন।এদিকে পর পর তিন সপ্তাহ আব্বা নোয়াখালী ঘাট থেকে ফেরত গিয়েছেন আকাশের অবস্থা বেগতিক দেখে। আব্বার অনুপস্থিতিতে মেহমানদারি করতে গিয়ে আম্মা আর দাদুর ভাণ্ডার তখন প্রায় শুন্যের কোটায়। যদিও হাঁস, মুরগী আম্মা নিজেই পালতেন আর প্রতিদিন পুকুর থেকে মাছ ধরতাম। তাছাড়া আম্মা কিছু কিছু শাকসবজির গাছ বাড়িতেই লাগিয়েছিলেন। তবে নদীর দেশের মানুষজন পুকুরের মাছ এতোটা তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারেনা।
ওদের রসনার প্রকৃত স্বাদ মেটে নদীর মাছেই।তবু হাতে নগদ টাকা না থাকলে একধরনের অনিশ্চিয়তায় ভাসতে হয়। আব্বা না আসায় মধুর ছাকও মধুতে টইটম্বুর হয়ে আছে। তাই আমি আর মান্না মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার আমরা নিজেরাই পুরো প্রক্রিয়াটি একা একাই সম্পাদন করবো। সিদ্ধান্ততো নিলাম কিন্তু সিগারেটের ব্যাবহারটাই পুরো প্রসেসে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ভাবলাম, সিগারেটতো আমরা নেশার কাজে ব্যবহার করবো না কিংবা ধোঁয়া গিলেও ফেলবো না।তাই নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন গুনাহ হলেও মাফ করে দিবেন। এরকম ভাবনা থেকেই মান্নাকে বললাম, এরকম সঙ্কটের মুহূর্তে বেনসন সিগারেট কিনে টাকা অপচয় করে কোন লাভ নেই। তারচেয়ে তৌহিদকে দিয়ে বক বিড়ির প্যাকেট কিনিয়ে নিই। তৌহিদ আম্মার হেল্পার হলেও সারাক্ষণ আমাদের পিছু পিছু ঘুরতেই বেশি ভালোবাসতো। ওর গায়ের চকচকে রঙের জন্যই ওকে তিনগোয়েন্দা সিরিজের মুসা আমানের রোলটা সবসময় দিতাম। তাতেই সে মহাখুশিতে মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁতের ঝিলিক তুলে হেসে দিত।যাইহোক মান্না বললো, বক বিড়ির বিদঘুটে গন্ধ সহ্য করতে পারবি? বললাম, খেটে খাওয়া মানুষেরা যদি স্বাচ্ছন্দ্যে খেতে পারে তাহলে আমি ও নিশ্চয়ই সহ্য করে নিতে পারব। আমি নিজেকে সাধারণ মানুষের বাইরে কিছুই ভাবিনা।তৌহিদ বুলেট বেগে বকবিড়ির প্যাকেট হাতে ছুটে এল। এরপর দক্ষ মৌয়াল সেজে খুব নিঁখুতভাবে মধু সংগ্রহ করলাম। নিজের কারিশমায় নিজেই নিজেকে মনে মনে বাহবা দিতে ভুল করলাম না।এমন সময় হঠাৎ টেলিগ্রামে খালুর অসুস্থতার খবর এলো।সেসময় পাহাড়ি এলাকায় মশার কামড়ে প্রাণঘাতি একধরনের জ্বর হতো। তেমন কিছুর আশঙ্কা করে খবরটা শোনার পর থেকেই বড় খালাম্মা রীতিমতো কান্নার জোয়ার বইয়ে দিলো। যাওয়ার কোন উপায় নেই দেখেই হয়তো আজ থেকে গেছেন নতুবা বড় খালাম্মাকে কোন মতেই এক মুহূর্তও ধরে রাখা যেত না।পরের দিনই একটা জাহাজ হাতিয়া থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।তাই উনি কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছানো শুরু করলেন। এদিকে আম্মা আর দাদুকে দেখলাম আড়ালে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে ফিসফিস করে কী যেন আলোচনা করছেন। কাছে যেতেই শুনলাম, উনারা বড় খালাম্মার পথ ভাড়ার টাকা কোত্থেকে জোগাড় করে দিবেন তা নিয়েই কথা বলছেন। মাসের শেষের দিক হওয়ায় দাদুকে বড়কাকা যে টাকা পাঠায় তা তখনও এসে পৌঁছায়নি। কথাগুলো শুনে ফেলার পর থেকে আমিও চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম। এই অবস্থায় বড় খালাম্মাকে কথাটা বলা সমীচীন হতো না। কারণ, উনার কাছে ও কোন টাকা ছিলো না বিধায় ব্যাথার ভার আরো দ্বিগুণ হয়ে যেতো।বড় খালাম্মা কখনো কিছুই জমাতে পারতেন না। সবকিছু খরচ করে খালি হাতে আরামসে ঘুরে বেড়াতেন। মনে মনে জানতেন, যাওয়ার সময় ভাড়ার টাকার অভাব হবে না। বড় বোন আর খালাজীতো আছেই। এবার আব্বা কিছু দিন যাবত না আসাতেই যতো সমস্যা তৈরি হল। এমন সময় আমাদের বাড়িতে বর্ণা এল। বর্ণাকে সবাই চিনতে পেরেছেন? সেই যে কিল্লার বাড়িতে জ্বীনে ভর করেছিল। হঠাৎ কী মনে করে বর্ণাকে সমস্যাটি খুলে বললাম। তারপর সে টাকা জোগাড়ের ক্ষেত্রে কোন সাহায্য করতে পারবে কীনা তাও জানতে চাইলাম। বর্ণা বেশ ভারিক্কি স্বরে বলল,এতোগুলো টাকাতো কেউ এমনি এমনি দিবে না।কিছু বন্ধকস্বরূপ রাখা গেলে না হয় এক জায়গা থেকে চেষ্টা করা যেত। আমার মাথায় এমন কোন সম্ভাবনার কথা উঁকি দেয়নি। তাই মনের অজান্তেই হাত চলে গেল গলাতে। সেখানেই তো একটা চেইন শোভা বর্ধন করছে । এই চেইনটি আমার ক্লাস ফোরের বৎসর বড়কাকা কিনে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে সবসময় এটা আমার গলাতেই শোভা পায়।তাই ওকে তৎক্ষনাৎ বলে ফেললাম, এই চেইনটি বন্ধক রেখে একহাজার টাকা ধার নেয়া যাবেনা? বললঃ সত্যিই যদি সেরকম কিছু ভেবে থাকিস তাহলে তাড়াতাড়ি পা চালা।তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।একটু পরেই আবার সূর্য ডুবে যাবে। কাউকে কিছু না বলে আমরা দুজন বেরিয়ে গেলাম। বাজারের দক্ষিণের অংশের কিছুটা পিছনে একটা বাড়ির সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বর্ণা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।
লেখক : হাতিয়ারই সন্তান । তাঁর বাবা মাহতাব উদ্দিন আহমেদ মিলন (ম্যানেজার সোনালী ব্যাংক), ড্যাডি আবু ইউসুফ হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ বেলাল (অবসরপ্রাপ্ত জয়েন্ট সেক্রেটারি) । তিনি ইডেন কলেজ থেকে গণিতে অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় গৃহিনী হিসেবে বসবাস করছেন। তাঁর লেখা ”একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথন” উপন্যাস বইটি পাঠকের কাছে খুবই সমাদৃত হওয়ায় এর কয়েকটি পর্ব হাতিয়া কণ্ঠে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ।