শারমিনের গল্প : একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথন (পর্ব-৫০)
এতো কিছুর পরেও দু’চারদিন অন্তর অন্তর মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে উঠতো।সাথে সাথে একটু বেড়াতে না গেলে অস্থির লাগত।তাই সুলতু কিংবা ছোট্টফুদের(লিনা) বাড়িতে স্কুল থেকে ফেরার সময় চলে যেতাম। আর আমি না গেলে ওরাই আমার সাথে আমাদের বাড়িতে চলে আসতো। সুলতুদের নতুন পাড়ায় সবাই একে অপরের সাথে মিলে মিশে একত্ব হয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতো। তাই ওখানে গেলে সময়টা বেশ ভালো কাটতো।সবাই মিলে একসাথে রেডিও শোনা, যে কোন মাখানো একসাথে বসে জিহ্বায় টসটসে আওয়াজ তুলে একটু একটু করে খাওয়া, আড্ডাবাজি সবই অনবদ্য হয়ে উঠতো। মাঝে মাঝে পিকনিকেরও আয়োজন থাকতো। আমি আর মান্না ঐ পাড়ার বাসিন্দা না হয়ে ও সেই পিকনিকে ঠিকই দাওয়াত পেতাম। মমতা আপারতো(হজু ভাইয়ার বড় বোন) নামই হয়ে গিয়েছিল বিবিসি নিউজ। যেখানে যে ঘটনা কিংবা রটনায় ঘটতো সব তার মাধ্যমে এলাকার সবাই মুহূর্তেই জেনে যেত।অতি সহজ সরল হাসিখুশি মমতা আপা সবার মন জয় করে নিতে মুহূর্ত মাত্র সময় নেয়নি।জুলি আপারাও সুলতুদের পাশেই বাড়ি করেছিল।একবারতো মাসুম মামা ছুটিতে বাড়িতে আসার সময় মাটি দিয়ে বানানো কলার কাঁদি নিয়ে এসে ড্রয়িং রুমের শোকেসের উপর একটা প্লেটে সাজিয়ে রেখেছিল। তার একটু পর নানু(মাসুম মামার আব্বা) অফিস থেকে ফিরেই পাকা কলাগুলো দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, কে এনেছে? নানু(মাসুম মামার আম্মা) বললেন,আপনার জন্য মাসুম চিটাগং থেকে কলাগুলো নিয়ে এসেছে। খেয়ে দেখেন।নানু খাওয়ার জন্য কলা নিতে গিয়ে যখন ডস খেলেন ততক্ষণে ধৈর্য্য ধরে এতোক্ষণ চুপ থাকা আমরা সবাই হেসে কুটিকুটি।আহারে একসুতোয় বাঁধা আমরা সবাই আজ একেকজন একেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছি।কিন্তু সুতার গিট্টুটা আজো বুঝি কোথাও অদৃশ্য ভাবে আটকে আছে। না হলে সবাইকে আবার কাছে পাওয়ার আকুতি কেন মনের কোণে কিলবিল করে?একবার আমাদের পিছনের বারান্দার খাটে শুয়ে শুয়ে আমি,সুলতু আর ছোট্টফু আড্ডা দিচ্ছিলাম। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ডায়েরিতে আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে হঠাৎ লিখে ফেললাম,”আমরা তিনজনের কেউ সর্বনাশা প্রেমে জড়াবো না।মোদ্দাকথা, প্রেম করবো না।” লেখাটা ওদের দুজনকে দেখিয়ে বললাম, তোরা লেখাটার নীচে একে একে সাইন কর।বলতে বলতে আমি নিজেই সাইন করে ফেললাম। ছোট্টফু বলল,মনের মাঝে যদি কখনো প্রেম উঁকি ঝুঁকি মেরে যায় তাহলে কী করবো?নাকি মনের দুয়ারেও তুই তালা মেরে দিবি?বললামঃ মনে মনে করলে ও বাস্তবে করা যাবেনা।কিন্তু তোর কথাগুলো কেমন যেন মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলছে? মনের মাঝে আবার কাউকে লুকিয়ে রেখেছিস নাকি? ছোট্টফু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল, এখনো চিন্তা করার মতো কাউকে পাইনি তবে ভবিষ্যতকে ক্লিয়ার করে নিচ্ছি। বললামঃ যা,তোকে মনে মনে যতো খুশি প্রেম করার ছাড়পত্র দিয়ে দিলাম। তবে খবরদার! বাস্তবে যেন না দেখি। এবার সুলতু তুইও তোর কোন বক্তব্য থাকলে এক্ষুনি বলে ফেল? পরে আবার কোন ধ্যানায়-প্যানায় চলবে না। সুলতু খালা বললোঃ আমার মনে হয়না কেউ কখনো আমার সাথে প্রেম করতে চাইবে। তাই তেমন কোন ভাবনাও আমার নেই। লিনা মাঝখানে ফোঁড়ন কেটে বলল, ঠিকই বলেছিস। কেউ কখনো আমাদেরকে তার ভালো লাগার কথা বলবে এরকমটা আমিও বিশ্বাস করিনা। তবু সবকিছু খোলাসা করার জন্যই কথাগুলো বলেছিলাম। সুলতু পুনরায় বলে উঠলো, আমার কথা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।আমরা তার দিকে তাকাতেই বলে উঠলো, যদি কখনো অন্ধ, খোঁড়া কিংবা এধরনের অসহায় কারো দেখা পাই তাহলে কী প্রেম না করে বিয়ে করতে পারব? ঃহঠাৎ এমন চিন্তাধারা?ঃ এ ধরনের মানুষেরা এতোটাই অসহায় হয় যে ওদের কথা ভাবলেই কেমন যেন মায়া লাগে। বললামঃতোর ভাবনা সম্মান পাওয়ার যোগ্য।তবে মুরব্বিরা কেউ মেনে নিবেন কি-না সেটাই প্রশ্ন। তুই টেনশন করিস না। এরকম কোন মুহূর্ত তোর জীবনে কখনো এলে আমাদেরকে তোর পাশে পাবি।এরপর ওরা একে একে স্বাক্ষর দিল।বিধাতা হয়তো সেদিন আড়ালে মুচকি হেসেছিল। কারণ পরবর্তীতে কলেজের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের পরেই ছোট্টফু আইন্না লাসার(সজনে গাছের ছালে একধরনের আঠা হয় যা কোন কিছুতে একবার আটকে গেলে ছাড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠে) মতো কঠিন প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই বাঁধ ভাঙা দুর্দমনীয় প্রেম তাকে কোথায় খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তা না হয় তার জবানিতেই ভাবতে ভাবতে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই। হাতিয়া দ্বীপ কলেজ থেকে পিকনিকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য বাস দাঁড়িয়ে আছে। গন্তব্য স্থান ওছখালীতে অবস্থিত দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থাে। আগে সংস্থাটি চৌরঙ্গীতেই ছিল। নদী কাছে চলে আসায় সংস্থাটিকে ওছখালীতে স্থানান্তর করে নেয়া হয়েছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘষে মেজে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থাটিতে। সংস্থাটির যাত্রা শুরুই হয়েছিল ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর বিপর্যস্ত জনজীবনের পাশে দাঁড়ানোর অভিলক্ষে। এরপর ধীরে ধীরে দুর্যোগ মোকাবিলা হতে শুরু করে নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা ছাড়াও নানারকম সামাজিক সহায়তাকারী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। আমি(লীনা) বাসন্তী রঙের শাড়ির কুচিকে আলগোছে আলগে বাসে উঠে পড়লাম। আনারকলি খোঁপায় একটা ফুল গুঁজে নিলে মন্দ হতো না। হাতের কাছে কোন ফুল না পাওয়ায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। কালো মেয়েদের এতো শখ ভালো না। সবাই উল্টো হয়তো মুখ গুঁজে হাসতো। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে আমারই এক ক্লাসমেট বাসে উঠলো। বিহ্বল শব্দটাই কিঞ্চিৎ ভুল আছে।সত্য কথা বলতে কী, এর আগে কোন ছেলের চোখে এমন মুগ্ধ আবেশ ধরা চাহনি আমি বাস্তবে দেখিনি। তাই আমি ও অপলকে তাকিয়ে ছিলাম।একসাথে পড়লেও ছেলেটির সাথে আমার কখনো সখ্যতা গড়ে উঠেনি।তাই বোকার মতো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলে মনে মনে নিজেই নিজেকে ভৎসনা করে চোখ সরিয়ে নিলাম।আমার পাশে যে বসেছিল সে বিষয়টি ঠিকই খেয়াল করে একটু টিপ্পনী ও কেটে নিল।ধুত্তেরি, ছেলেটা এমন এক আসনে বসেছে যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বারবার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে রোমান্টিক মেয়েদের দলে কখনো মনের ভুলেও ভাবিনা। তাই অযাচিত চোখাচোখির অবসান ঘটাতে বাইরের প্রকৃতিতে ডুব দিলাম।পিকনিক স্পটে নেমেই মন ভালো হয়ে গেল। দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা যখন চৌরঙ্গীতে এ,এম,হাই স্কুলের পাশে ছিল তখন প্রায়ই বন্ধুরা মিলে ঢুঁ মারতাম। কতোদিন পর আবার প্রিয় জায়গাটার দেখা পেলাম নতুন রূপে। সব ঘুরে ফিরে দেখার ফাঁকে ঠিকই লক্ষ্য করলাম, দুটো চোখের দৃষ্টি আমার পিছু ছাড়ছে না।এজন্যই বুঝি লেখকেরা বলেন, মেয়েদের অনুভবের তীব্রতা এত প্রখর হয় যে, মনে হয় পিছনে ও একটা চোখ আছে। আমার দুজন বন্ধু হাসতে হাসতে এদিকে এগিয়ে এসে বললো, কী রে! তোর মায়াজালে যে একজন কুপোকাত হয়ে গেছে সেই খবর রাখিস? মনের মাঝে সম্পূর্ণ অচেনা এক দুরুদুরু অনুভূতি জেগে উঠলেও হেসে বললাম, বন্ধুগণ ঠাট্টা করারও যে একটা সীমা আছে সেটাই হয়তো তোরা ভুলে গেছিস। ঃনারে।সিরিয়াসলি। একজনতো তোর সাথে একাকী কিছু কথা বলার জন্য পেরেশান হয়ে আছে। ঃওঃ তোরা কী তার দূত? ঃহা হা। তুই এমন রেগে গেলি কেন? সবার জীবনেই এমন কিছু না কিছু নাটকীয় মুহূর্ত আসে। ঃসবার জীবনে এলেও আমার জীবনে আসার কথা না। আমি এমন কোন আহামরি সুন্দরীদের কাতারে নেই যে আমার সাথে কারো বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের ইচ্ছা হতে পারে।তাই এসব ফালতু কথা বার্তা আমার সামনে আর কখনো বলিস না। ঃতুই হয়তো জানিস না, কেউ কেউ কৃষ্ণকলিতেই সুখ খুঁজে পায় কিংবা আঁধারের রূপ দেখেই বেশি বিমোহিত হয় অথবা চঞ্চলা দুরন্তেই হারিয়ে যেতে বেশি ভালোবাসে। আমাদের বন্ধুটি আর যায় হোক না কেন,স্বীকার না করে উপায় নেই যে তার মনের দৃষ্টি অতি স্বচ্ছ।হলফ করে বলতে পারি, সেখানে এখনো কোন পঙ্কিলতা আগাছা গাড়তে পারেনি। ঃআর সাফাই গাইতে হবে না। সেতো আমারও ক্লাসমেট। তাকে বলে দিস, আড়ালে আবডালে গিয়ে কথা বলাটা আমার সাথে ঠিক যায়না। এটুকু বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে কী ছেঁচড়া ধরনের মেয়ে পেয়েছে নাকি যে বললেই দৌড় দিব!মনে মনে একটু বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। পাঁচ ভাইয়ের (যদিও এক ভাই চঞ্চন আজ আর বেঁচে নেই, আল্লাহ ওকে বেহেশত নসীব করুক। ) অতি আদরে আমি এমনিতেই একটু একরোখা। সবসময় ঠাসঠাস করে বলে ফেলি মনে যা-ই আসুক। আমার মতো মেয়েকেতো যে কোন ছেলেরই এড়িয়ে চলার কথা। অযথা ভাবনাগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে পিকনিকের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলাম। সেদিন পিকনিক থেকে বাসে করে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে দেখি, তখনও বাড়ি থেকে কেউ আমাকে এগিয়ে নিতে আসেনি। তাই একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় ছেলেটা হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এসে একটি গাঁদাফুল আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, তোমার জন্য ফুলটা নিয়ে এসেছিলাম। থতমত খেয়ে বললাম, কেন? আমাকে কেন? বললঃক্লাসমেট কিংবা বন্ধু হিসাবে কী দিতে পারিনা?বললামঃআমার যদি ফুল নেয়ার ইচ্ছা থাকত তাহলেতো দ্বীপ উন্নয়ন থেকেই নিয়ে আসতে পারতাম। ঐ ফুল পেয়ে যারা খুশিতে গদগদ হবে তুমি তাদেরকেই না হয় ফুলটা দিয়ে দিও।বললঃবাসন্তীবরণ কইন্যার ভাবনা ফুলটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। অন্য কোথাও গেলে যে এর আমিত্বই হারিয়ে যাবে?দূর থেকে সেজভাইকে আসতে দেখে কথায় ছেদ টেনে দিল।বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, ছেলেটাতো ভালোই গুছিয়ে কাব্য করে কথা বলে।অবশ্য ছাত্র হিসাবেও ক্লাসে প্রথম সারির দিকে। দেখতে ও মাশাল্লাহ দিলে দারুণ সুন্দর, হ্যান্ডসাম। নিজের চিন্তার এমন ধারার গতিপ্রকৃতি দেখে নিজেই বিরক্ত হয়ে উঠলাম। শেষে মনে মনে ধুত্তেরি বলে সেজভাইয়ের সাথে গল্পে মেতে উঠলাম।এরপর প্রায় কলেজে আখতারের সাথে চোখাচোখি হয়ে যেতো যদিও আমি এড়িয়ে চলতে চাইতাম।ওহহো রে! এতোক্ষণতো বলাই হয়নি ছেলেটার নাম আখতার। ধীর ধীরে আখতারের চলনবলন আর মন-মানসিকতা দূর থেকে খেয়াল করতে শুরু করলাম অনেকটা মনের অজান্তেই।কোন কিছুতেই কটু কিছু চোখে পড়লো না।একদিন কলেজ ছুটির পর যখন বাড়ির দিকে রওনা দিলাম তখন হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে আখতার আমার হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, আমি হাতে কোনো আগুনের গোলায় চেপে ধরেছি।
আর তারই উত্তাপে ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে যাচ্ছি। কী করে যে ভুতগ্রস্থের মতো সেদিন বাড়িয়ে ফিরেছিলাম নিজেও জানিনা।জামাকাপড় না ছেড়েই বিছানায় উপুড় হয়ে চিঠিটা খুললাম।কোন সম্বোধন ছাড়াই লেখাটা শুরু হয়েছে। বুকের ধুকপুক এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল যে চিঠিটা মনে মনে পড়ার সময় মনে হচ্ছিল সবাই শুনে ফেলছে। আবার পড়া শুরু করলাম,,,,, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার সাজানো বাগানের হাজারো ফুলের সমাবেশে যে ফুলটিকে দেখার হাহাকারে আমার হৃদয় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিল, সেতো তুমি ছাড়া আর কেউ নও।পিকনিকে আগত জন সমাগমে ভীত হয়ে আবার যখন রাজহংসের ঝাঁক সোনালী রৌদ্রুরে রূপালী ঝিলিক তুলে পানিতে ঝাপ দিয়ে জলকেলি খেলায় আপনমনে মেতে উঠেছিল তখনও নতুনভাবে আবির্ভূত এক জুটিকে তাদের মাঝে আবিষ্কার করে আমি আপ্লূত হয়ে উঠেছিলাম।এমনি করেই প্রতিনিয়ত তোমায় আমি নব নব রূপে আবিষ্কার করে নতুন আবেগে ভেসে যাই।জানিনা এই অচেনা আবেগের জন্ম কোথায়??? শুধু মনের কোণে একটাই জিজ্ঞাসা উঁকি ঝুঁকি মেরে যায়।আমার জীবনের অধরা স্বপ্ন পূরণের দিনগুলোতে কী তুমি আমার চিরসখা হবে?????ঠিক যেভাবে ঘূর্ণিবায়ু প্রবাহিত হয়ে সব দিক দিশাহীন করে দেয় তেমনিভাবে এই চিঠিটি আমার সব এলোমেলো করে দিল।আমি কোন পরিবারের মেয়ে, কী আমার পরিচয়,বাবা-মা কিংবা কাদের আদরের কলিজার টুকরো বোন সবই মুহূর্তে বিস্মৃত হলাম। আমার আকাশ জুড়ে শুধু একটা তারকায় জ্বলজ্বল করছিল।আমি মেঘের ভেলায় গা ভাসিয়ে উড়তে উড়তে সেই তারকাটির কাছে পৌঁছাতে চাচ্ছিলাম।জানিনা স্বপ্নের ঘোরে কখন আমি চিঠিটার প্রতি উত্তর লিখে ফেলেছিলাম। তারপর এভাবেই চিঠির ভাষায় কথা চলার এক পর্যায়ে আমরা দুজন একদিন অনেক দূরের নদীর কূলে প্রথম বেড়াতে গেলাম। কাছাকাছি নদীর কূলে বেড়াতে গেলে পরিচিত কারো চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় থেকেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলাম। আখতার সেদিন কথায় কথায় বলেছিল, তাদের আর্থিক অবস্থা কিংবা বংশ মর্যাদা আমাদের মতো এতটা বলিষ্ঠ নয়।তাই সে আমাকে মনের কাছাকাছি পেয়ে ও হারিয়ে ফেলার আতঙ্কে আতঙ্কিত থাকে। আমি ওকে বলেছিলাম “প্রেম ন জানে জাত”। তুমি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলে আমি উত্তাল সমুদ্র পেরুতে ও একবারের জন্যও দ্বিধাবোধ করবো না।লজ্জায় কিংবা অতি ভদ্রতার জন্য সে আমার হাত ছুঁয়ে কোন ভরসা দেয়ার পরিবর্তে মুখের ভাষায় ভরসা দিয়েছিল। এরপর আমরা দুই -তিন মাস অন্তর আরো দুবার সবার নজর এড়িয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম।কেউ টের পাইনি। হাতিয়ায় নিশ্চিতে প্রেম করা খুবই কঠিন। সবসময় কারো চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় থেকেই যায়।ঠিক যেদিন আমাদের সম্পর্কের ছয়মাস পূর্ণ হলো সেই দিন আমরা একটা রিকশা ভাড়া করে হাতিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত আমানুল্লাহ চরে ঘুরতে গেলাম আবার কলেজ টাইমের সাথে সময় এডজাস্ট করে সময়মতো সহিসালামতে বাড়িতে ঢুকে দেখি আম্মার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে আছে। অজানা আশঙ্কায় মনের ভিতরে খচখচ করে উঠলো।তাই কিছুটা তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরুতে যাব এমন সময় আম্মা আমাকে কিছুটা ঠেলে রুমে ঢুকে দরজা টেনে দিয়ে বললেন, তুই আজ কোথায় গিয়েছিলি?বললামঃ কলেজে।ঃমিথ্যার ফুলঝুরি না ছুটিয়ে সত্যি করে বলতো কই গিয়েছিলি?আর তোর সাথে যে ছেলেটি একই রিকশায় বসা ছিল সেই বা কে?ঃআম্মা আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝি পারছিনা। আমি তো কলেজ থেকেই ফিরলাম? ঃতাহলে তোর বাবার বন্ধু তোকে আর আরেকটা ছেলেকে চর আমানুল্লাহর দিকে যে রাস্তাটি গেছে সেই পথে আজ রিকশাতে বসে গল্প করা অবস্থায় আবিষ্কার করলো কী করে? লোকটা দৃশ্যটি দেখার পর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তোর বাবাকে এসে সব খুলে বলেছে।তোর কারণে আমাদের মান সম্মান কী ধূলোয় লুটাবে?আঙ্কেল কোথাকার কাকে দেখেছে তা নিয়ে তোমরা আমাকে সার্চ করা শুরু করলে? কী ক্ষুধা লেগে গেছে অথচ কিছু খেতে দেয়ার নাম ও নিচ্ছেন না। আম্মা কথাটা শুনে গটগট করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। আব্বাও আম্মার পিছু নিয়ে কী কথা হলো জানতে চাইলেন? আমি ঝাপসা ভাবে শুনলাম আম্মা বলছেন, আমরা বোধহয় অযথা অন্যের কথা শুনে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কথাটা শুনে আমার চোখে পানি চলে এল।আম্মা কী করে জানবেন যে,আমি নিজের ভালোবাসাকে সঙ্গোপন করার জন্য অবলীলায় মিথ্যার আশ্রয় নিতে সেকেন্ড মাত্র সময়ও নিইনি। এই আমিতো আমার নিজের কাছেই সম্পূর্ণ অচেনা।এরপর থেকে আমরা আরও সতর্ক হয়ে গেলাম।কলেজে যাওয়ার পথে একবাসে উঠলেও দুজন আলাদা জায়গায় বসতাম। কথা বলার তেমন সুযোগ পেতাম না।তবু সেজ ভাই নানান ভাবে খোঁজ খবর নিয়ে সব জেনে গিয়ে আমাকে চেপে ধরে কথা বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। এবার ও আমি ভয়ে সব অস্বীকার করলাম। সেজ ভাই বিশ্বাসতো করলোই না উল্টো বললেন, তুই যা করছিস তা কী ঠিক? একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ। তুইতো এমন ছিলি না? আমাদেরকে কষ্ট দিয়ে তুই কী করে মিছে ছলনায় ডুবে গেলি? আমিতো আমার এই বোনকে চিনতে পারছিনা।কথাটা বলতে বলতে সেজভাই হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল।আমি তখন এতোটাই পাষাণ হয়ে গিয়েছিলাম যে পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইলাম। আমার মস্তিষ্কে তখন রঙিন ঘুড়িরা এলোপাতাড়ি উড়াউড়ি করছিল।আর বাকী সব কেমন শূন্য হয়ে গিয়েছিল। আবারও বললেনঃতুই কী চাস এর বিনিময়ে? তুই চাইলে আকাশের তারাটাও এনে দিতে চেষ্টা করবো কিন্তু তুই কেন বুঝতে পারছিস না এই অসম সম্পর্ক আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া কখনই সম্ভব না। লেভেল বুঝে যদি সম্পর্কে জড়াতিস তাহলে আজ এতো ভোগান্তি হতো না। সবার সব হতাশা কিংবা কান্নাগুলো আমার মন ছুঁয়ে রক্তের ধারা হয়ে নেমে গেলেও আদৌ আমি কিছুই করতে পারতাম না। আখতারের মনে কষ্ট দেয়ার কথা কেন জানি স্বপ্নেরও অগোচর হয়ে উঠেছিল। কী করে আমার এমন আমূল-পরিবর্তন ঘটেছিলো তা নিজেও ঠাহর করতে পারিনি। ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতায় তখন হারিয়ে ফেলেছিলাম। এমনকি লেখা পড়াও লাটে উঠেছিল। সেই অস্থির মানসিক অবস্থায় কোনমতে লোকদেখানো পরীক্ষা দিলাম যদি ও জানি যে কোনভাবেই পাশ করতে পারবোনা। পরীক্ষা শেষ হতেই আমাকে ব্যাগ গুছাতে বললেন আম্মা। আমাকে আগামীকাল ভোরেই ঢাকার নয়াটোলাতে বড় ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। তাদের ধারণা,জায়গার চেঞ্জ হলেই মনের পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমি কথাটা শুনে হেসে দিলাম। প্রেমে না পড়লে কেউ কোনদিন বুঝতেই পারবে না এর হেপা কী? চোখের আড়াল হলেই
যদি কেউ মন থেকে মুছে যেতো তবেতো এই পৃথিবীতে কোনদিন প্রেমের কোন উপাখ্যানই রচিত হতো না।আমার মুখে হাসি দেখে আম্মা কেঁদে দিলেন। বললেনঃএখন আমাদের কাঁদিয়ে তুই হাসিস। একদিন হয়তো তোর জীবনে এমন দিন আসবে যে তুই আড়ালে কাঁদবি কিন্তু সেই কান্নার অনুভূতিগুলো শেয়ার করার জন্য আমাদেরকে তোর পাশে পাবি না। পৃথিবীটাকে সানগ্লাসের ভিতর থেকে জরিপ না করে একটু খোলা চোখে তাকিয়ে দেখ।তোর সব ঘোর কেটে যাবে। আমি নিজেও জানিনা আমি কী করে এমন হয়ে গেলাম? বাবামায়ের কোলে সেই আগের আমি যেভাবে ঝাপিয়ে পড়তাম সেই পথ কী করে নিজের হাতে রুদ্ধ করে দিলাম? নয়াটোলার বাসাটা বেশ বড় হলেও মূলত ছিল ব্যাচেলর টাইপের। এখানে কেউ চাকরি, কেউ বা পড়াশোনার প্রয়োজনে থাকতো। এখানে আসা অব্দি আখতারের কথা মনে পড়লেই আমার সব কেমন উথাল পাথাল হয়ে যেতো।হঠাৎই চলে আসাতে কোন যোগাযোগ করে জানিয়ে ও আসতে পারিনি।কারণ আমাকে সেজভাই সারাক্ষণই পাহারার উপর রেখেছিল। তাই মনের মাঝে অদ্ভুত এক শঙ্কা কাজ করতো। দিনগুলোকে দিন মনে না হয়ে বছর মনে হতো।চারদেয়ালে মানুষকে বন্দী করা গেলেও তার মনকে কী আবদ্ধ করে রাখা যায়?এই সহজ সত্যটা বোঝার ক্ষমতা কারোর নেই। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর দেখা গেল, আমি ফেল করেছি। আমি বিষয়টি আগেই আন্দাজ করেছিলাম বিধায় খুব একটা আঘাত পাইনি বরং মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। আবারও হাতিয়াতে ফেরার পথ তৈরি হওয়ায় মনে মনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলাম। বড়ভাই(উনি তখন বিটিভিতে বার্তা প্রযোজক হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন।) হাতিয়াতে ফেরার দিন বললেন, আমাদেরকেতো তুই শেষ করে দিলি??? তুই আমাদের একটি মাত্র আদরের বোন অথচ তোর কাছ থেকেই আমরা সবচেয়ে বড় দুঃখ পেলাম। এখনো সময় আছে। চাইলেই তুই নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করে নিতে পারিস।ছোট অবস্থায় ভুল করাটাই স্বাভাবিকতার মধ্যে পড়ে।কিন্তু সেই ভুলকে জিইয়ে রাখাটা হলো আসল বোকামি। আমি চুপচাপ শুনে গেলাম কথাগুলো। সেই সময় এই কথাগুলো আমার মনে সামান্য আঁচড় কাটা ছাড়া কোনরূপ আলোড়নই তুলেনি। দ্বিতীয় বার পরীক্ষার ঠিক আগে হাতিয়ায় এসে পৌঁছালাম। আমাকে সারাক্ষণ কড়া নজরদারির উপরে রাখা হল। কিছুতেই দেখা করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। পরীক্ষার দিন সেজভাই আমাকে নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসে উঠতেই বুকের ভিতরে ধ্বক করে ড্রাম বেজে উঠল। আখতাররের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এতোদিন পরে দেখেও চোখ সরিয়ে নিতে হল।সেজভাই কটমট করে তাকিয়ে আছে। অতীতে ও কয়েকবার সেজভাই আখতারকে এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছিল। তাই নিজেকে সংযত করলাম।আমি চাইছিলাম না আমার কারণে আখতার নতুন করে হেনস্তা হোক।আল্লাহ তায়ালায় যখন আবার আমাদের নতুন করে দেখা করিয়ে দিলেন তখন আরেকটু ধৈর্য্য ধারণ করে দেখিনা, সামনে কী ঘটে? বাস থেকে নেমে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করার সময়ও আড়চোখে দেখলাম আখতার ও ভিতরে প্রবেশ করছে।ঠিক সাড়ে নয়টার ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে পরীক্ষার্থী ছাড়া অন্যরা হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সেজভাই ও এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি মেরে যখন আখতারের ছায়ার টিকিটিও খুঁজে পেলো না তখন সেও বেড়িয়ে যেতেই আখতার কোত্থেকে উদয় হয়ে আমাকে ছাদে উঠে যেতে ইশারা করল।আমি চঞ্চলা হরিণীর মতোই হাওয়ার বেগে ছাদে উঠে গেলাম। আখতার সবসময় বলতো, আমার চঞ্চলতার জন্যই ও আমাকে প্রথম ভালোবেসে ফেলেছিল।ছাদে উঠার সময় আমি ভুলে গিয়েছিলাম পরীক্ষার কথাও। আমাকে কাছে পেয়ে আজ আর আখতার নিজেকে সামলাতে পারলোনা। প্রথম বারের মতো আমার হাত দুটো ওর হাতের মুঠোতে চেপে ধরল। জানতে পারলাম প্রেম আমাদেরকে এতোটাই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যে আমরা উভয়ই পড়ার জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম।তার ফলশ্রুতিতে ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আখতার ফেল করেছে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম,এবার ভালোমতো পরীক্ষা দিব।কারণ,আমরা নিজেরা যদি প্রতিষ্ঠিত হতে না পারি তাহলে কেউ কোনদিন আমাদের মেনে নিবে না।এরপর আমরা পরীক্ষা দেয়ার জন্য নীচে নেমে এলাম।
পরীক্ষার দিনগুলোতে সেজভাই এর কড়া পাহারায় হলে প্রবেশ করলেও আমরা পাঁচ মিনিটের জন্য ছাদে চলে যেতাম। এবার আর ভুল করলাম না। আখতার তার এক বন্ধুর বোনের ঠিকানা আমাকে দিল যিনি নয়াটোলাতেই থাকেন। আর এখানকার ও একটা ঠিকানা দিল যে ঠিকানায় চিঠি লিখলে আখতার পেয়ে যাবে।ঠিকানাগুলো আমি মুখস্থ করে নিলাম।যা ধারণা করেছিলাম তাই ঘটল।পরীক্ষার পরের দিনই আবার আমাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সেজভাই। আমাকে বিদায় দেয়ার সময় আম্মা অনেক কেঁদেছিলেন।চোখদুটো এমন লাল হয়ে ফুলে ছিল যে মনে হচ্ছিল সারারাত উনি না ঘুমিয়ে কেঁদেই কাটিয়েছেন।আব্বা চুপচাপ থমথমে মুখ করে এককোণে ঝিম মেরে বসেছিলেন। কষ্টে বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেলেও কিছু বলার মতো মুখ আমার ছিল না। সেদিন নিজেকে বড্ড অসহায় লেগেছিল। প্রথমবারের মতো আফসোস হল, কেন যে এমন সর্বনাশা প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে গেলাম?? আমার মতো যারা পরিবারের ভালোবাসার মানুষগুলোর কথা না ভেবেই আগুন রূপ প্রেমে আত্মাহুতি দেয় তাদেরকে এভাবেই নিবৃত্তে কষ্ট পেয়ে যেতে হয়।কষ্টে বুক বিদীর্ণ হয়ে গেলেও প্রকাশ করার মতো পরিবেশ থাকে না। প্রেমের যে মদিরা আমি গলাধঃকরণ করে ফেলেছি তা থেকে মরণের আগে বুঝি আমার মুক্তি নেই। সারাটা পথ নিজেকে নিজে প্রশ্নে বিদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একসময় সেজভাই এর কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেজভাই মনের সন্দেহ নিরসনে পরের দিন আমার ব্যাগ সার্চ করতেই আমাকে লেখা আখতারের চিঠিগুলো পেয়ে গেলেন। এখানে আসা অব্দি ওগুলোকে কোথাও লুকিয়ে ফেলার সুযোগ পাইনি।সেজভাই হয়তো ভেবেছিলেন, আমি ব্যাগে কোন ঠিকানা লুকিয়ে রেখেছি। সেটা না পেলেও কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সর্প রূপ চিঠিগুলো পেয়ে ভীষণ রেগেমেগে ওগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমার গায়েই যেন কেউ দাউদাউ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে কী জ্বলুনি, পুড়নি! ভাগ্যিস, আখতারের কাছ থেকে শোনা ঠিকানা দুটো মুখস্থ করে নিয়েছিলাম।না হলে সেগুলো সেজভাই দেখে ফেলতেন।সেজভাই এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে এরপর বেশ কয়েক দিন আমাকে চোখে চোখে রেখেছিলেন। আমি এমন ভান করলাম যেন পাহারার বিষয়টি আমি বুঝতেই পারিনি। একটু ঢিলে দেয়ার পর আমি প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ পাশের বাসার একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেললাম। ওর কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিলাম খুব কাছেই যে একটা পোস্ট অফিস আছে। একদিন সুযোগ বুঝে চিঠি পোস্ট করলাম।এরপর থেকে আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম একথা ভেবে, চিঠিটা যদি অন্য কারোর হস্তগত হয়ে যায়?সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে এর কয়েকদিন পর আখতারের বন্ধুর বোন চিঠির উত্তর নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির হলেন। কেউ কিচ্ছুটি টের পেলো না। এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায় চিঠির আদানপ্রদান চলতেই থাকলো। এদিকে আফ্রিনা আপুও(আমার চাচাতো বোন) এখানে এসে উঠেছেন।উনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাইট কোর্সে ‘ল’ নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। ক্লাস যেহেতু বিকাল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তাই আফ্রিআপুর সাথে নিরাপত্তার খাতিরে আমিও যেতাম। আমি ওখানে গিয়ে পাশের একটি রুমে অন্য আরো অনেকের সাথে অপেক্ষা করতাম। মাঝে মাঝে আফ্রি আপু ক্লাসের সংক্ষিপ্ত বিরতির ফাঁকে এসে আমাকে দেখে যেতেন।কথাগুলো চিঠিতে আখতারকে জানিয়েছিলাম। উত্তরে আখতার জানিয়েছিল, আমি বাইরে বেরুনোর সময় যেন সবসময় মেট্রিকের সার্টিফিকেট সাথে রাখি। কেন বলেছিল তা ব্যাখ্যা করেনি বিধায় কিছু না বুঝেই তার কথা পালন করার জন্য সার্টিফিকেট হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। একদিন আফ্রিআপুর ক্লাস শুরু হওয়ার পর কমনরুমে বসে আছি এমন সময় হঠাৎ চমকে দেখি, আখতার আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কী স্বপ্ন দেখছি না সত্যিই তাকে দেখছি তা বুঝতেই কিছুটা সময় লেগে গেল।আমি ভয় পেয়ে বললাম, তুমি এখানে এলে কেন?আফ্রিআপু কোনভাবে দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঃতাহলে আমরা আশেপাশের কোন গার্ডেন থেকেই না হয় ঘুরে আসি। তাহলে আফ্রিআপু টের পাবেন না। আমি বললাম, কোথাও গেলে যদি আফ্রিআপু ফেরার আগে ফিরতে না পারি?ঃআমাদের হাতে এখনো তিনঘণ্টার উপরে সময় আছে। এতো টেনশন করোনা। কতোদিন পরে দেখা হয়েছে। সময়টাকে এভাবে মাটি করে দিওনা। বললাম, সত্যিই বলছি, আজ কেন যেন আমার খুব ভয় ভয় লাগছে। আমার কোন কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে নিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে বসল। সিএনজি যে চলা শুরু করেছিল তা আর থামার কোন নাম-ই নিচ্ছে না। চোখের সামনে দিয়ে দুই তিনটি পার্ক অতিক্রম করে গেল কিন্তু কোথাও নামার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। কয়েকবার চেষ্টা করেও আখতার থেকে কোন সদুত্তর পেলাম না। ওর রহস্যময় আচরণে বুকের ভিতরের দুরুদুরু আওয়াজ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছিল।কোনভাবে আজকের এই অভিযানের কথা জানাজানি হয়ে গেলে আমাকে আর আস্ত না রেখে আলুভর্তায় বানিয়ে ফেলবে। কাকরাইল কাজী অফিসের সামনে এসে হাল্কা জ্যামে গাড়ির গতি স্লো হয়ে যাওয়ায় ভাবনাতে এলো, আমাকে বিয়ে করার জন্য কাজী অফিসে নিয়ে যাচ্ছে না তো? তাই হয়তো গাড়িটা আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে। একটু পর সকল উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে গাড়ি আবার সামনের দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে যেতে লাগলো। তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি??? ভাগ্য আমাকে কোন অজানায় নিয়ে যাচ্ছে??আজ রাতকে এতো ঘুটঘুটে লাগছে কেন? এমনি হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেলেও কোনটার সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।