গল্প : তোমায় গান শুনাবো (পর্বঃ৩)
শারমিন আকতার রানা
গুলঃ আবেগ! এই আবেগই আমাকে সারাটা জীবন ধরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।খড়কুটো অবলম্বন করে যাও বা থিতু হতে চেয়েছিলাম অভাগীর কপালে তাও সইলো না। আর গত কয়দিন ধরেতো খরস্রোতা আবেগে হাবুডুবুই খাচ্ছি। তুমি বিনা দিনগুলো স্মৃতি আঁকড়ে কী করে কাটবে ভাবতেই বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
জিহানঃ তোমার কথা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
গুলঃ যাহ!একদম মন খারাপ করবে না। আমি ঠিক আছি।
জিহানঃ কেন বিধাতা এমন করল?এমনটা না করলে কি হতো সৃষ্টিকর্তার? But ultimately got you,,,,,গুল,,,,,,
গুলঃহা হা। আমাকে একটু বেশি ভালোবাসেন সৃষ্টিকর্তা।তাই বেশি বেশি পরীক্ষা নিচ্ছেন।
জিহানঃ এখনো অনেকটা সময় সামনে আছে। ।।তুমি ভালো থেকো আমার গুল।। ইচ্ছা আছে, আল্লাহ যদি চান তো তোমার সাথে কখনো না কখনো আমার দেখা হবেই।
গুলঃ আমি ভালো থাকার চেষ্টা করি। কখনো মন খারাপ করিনা। নীলি( আমার মেয়ে) আমার খুব ভালো বন্ধু। ওর সাথে ওর সমান হয়ে যাই।
জিহানঃ এজন্যই আমার গুল অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তার হাসির ঝর্ণাধারাটাকেই সবাই দেখতে পায়, আর ধারার স্রোতটুকু সবার আড়ালেই আত্মগোপন করে। কথার পরতে কথার মালা গাঁথতে গিয়ে খেয়াল হল, একটি ফুল এখনো গাঁথা হয়নি।
গুলঃ তোমার কথায় মুক্তো ঝরে, মুগ্ধতার রেশ কাটতেই চাই না। কোন ফুলটির কথা বলছ?
জিহানঃ গায়ে হলুদের ভোরের কথা বলছি। তোমার প্রশ্নের উত্তর অব্যক্তই থেকে গেল। মুহূর্তেই Teen age এ ফিরে গেলাম। এনেছি আমার শত জনমের প্রেম আঁখি জলে গাঁথা মালা। তুমি তো তখন রবীন্দ্র সংগীতের ভক্ত ছিলে। জানো গানের পাখি,আমি সেই বয়সে ওরকম lyrics এর অর্থ ঠিক seriously নিতাম না। বিয়ে বাড়িতে আমার কোনদিকে নজর নেই, তুমি ছাড়া।
গুলঃ ইশ্,,,
জিহানঃ আর তোমার গান শোনা,,
গুলঃআমি কখন গান শোনালাম? মনে পড়ছে নাতো!
জিহানঃ তুমি ক্যাসেটে যে গান বাজাতে। মনে আছে, তুমি বিয়ে বাড়িতে যে কয়টা গান বাজিয়েছ প্রতিটি গানই আমাকে নিয়ে।
গুলঃহুম ঠিক তাই। আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই গো। ওয়াও!সময়টাকে আমারি মতো তুমি ও হৃদয়ে ধারণ করে আছ! মৌরী ফুপ্পির গায়ে হলুদের দিন তুমি আমার দিকে বারবার কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়েছিলে।সেই দৃষ্টির সম্মুখে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আমি ডুবে যাচ্ছিলাম।
জিহানঃ আমি কিছু বলতে চেয়েছিলাম।
গুল ঃ আমি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু কি বলবো বুঝছিলাম না। হায়! আজো মন গুমরে মরে সেই অব্যক্ত চোখের ভাষা বাণীতে শোনার আশায়।
জিহানঃ বারবার দরজার দিকে কাচারী ঘরের উঠানে গিয়ে কিছু বলতে চেয়েছি। But failed. Very simple,,,, আমি তোমাকে ভালোবাসি,,,,,,, ভালোবাসি,,,,,, ভালোবাসি,,,,,, গুল,,,,গুল আমার, গুলশিরিন।
গুলঃতুমি কিছু না বলায় পরে ভাবলাম আমারি বুঝার ভুল ছিল। অল্প বয়সটা তোমাকে দেখে পেকে গেছে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে আমি মোটেই পরিণত ছিলাম না।
জিহানঃ সেই বয়সে আশা করেছি তুমি আমাকে একইভাবে ভালোবাসার কথা জানাবে। ভালোবাসা,ভালো লাগার কথা বলবে।
গুলঃ মাথা খারাপ! হাতিয়াতে সম্ভব হতো না। ভেবেছিলাম স্ট্রীমারে করে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে সাহসী পদক্ষেপ নিব।কিন্তু তুমি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে।তোমার শূন্যতা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।মনে হয়েছিল পুরো বিয়ে বাড়িটাই বিরান,ফাঁকা।
জিহানঃ হুম। গুলঃ এখন অনেক সাহস।এখন চিৎকার দিয়ে বলতে পারবো।
জিহানঃ তখন হাতিয়াতে উপজেলা নির্বাচন।।।। এটা নিয়ে গন্ডগোল।।। ধর পাকড়।। আর্মির দৌড়ানী খেয়ে ভীষণ আহত অবস্থাতেই খবর পেলাম আমি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেছি। ঐ অবস্থায় ধরা পড়লেই জেলে যেতে হতো। তাই পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল কিছু দিন। আমি তো বলেছি I love you.,,,,you are my first love so far.
গুলঃ তোমার লেখাটি যতোবার পড়ছি বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
জিহানঃ গুল আমি তো ছিলাম বলীর পাঁঠা।। গন্ডগোলের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলাম।কিভাবে যে সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম সেটা নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়। একেবারে steamer এ ctg হয়ে train এ Dhaka.
গুলঃ এটাই কিন্তু তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল। না হলে স্টিমারে কথাটা বলা হয়ে যেতো। আফসোস!
জিহানঃ yes,,,,,missing you in steamer journey.
গুলঃ আসার সময় অনেক মিস করেছি।সাগরের নোনাজল আর আমার চোখের জলের কোন তফাৎ খুঁজে পাইনি।
জিহানঃ এখন চিৎকার করে কি বলতে পারবে? এখন তো তোমার অনেক সাহস।
গুলঃহা হা,,,,, লজ্জা লাগছে।
জিহানঃ বুঝেছি। বলো,,, না হলে আবার আফসোস করবে। আজকে বলে ফেলো,,,
গুলঃ আর হারাতে দিব না। আমি শুধু ভাববো এখনো পৃথিবীতে কেউ আমাকে ভালোবাসে।
জিহানঃ এই জনমে আর হারাবে না। হায়!হায়!কথাটা শোনার আগেই বেরসিক ফোনের চার্জ প্রায় শেষের দিকে। 7% left. কেন আগে খেয়াল করিনি? যে দিন গেছে সেই দিনগুলোতে সব বিষয়ে সাহসী হলে ও প্রেমের ব্যাপারে কেন যে ভীতু ছিলাম?
গুলঃ তখন তো আমিও ভীতু ছিলাম।
জিহানঃ তোমার আশকারা পেলে ঠিকই সাহসী হয়ে উঠতাম। তুমি যা গম্ভীর ছিলে,, কিন্তু একটু ও hints পেলাম না এটাই দুঃখ ।
গুলঃভয় পেয়েছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি বলে বসবে, এতো ছোট মেয়ে পাকামি করছে কেন?
জিহানঃ শুধু চোখে চোখে কথা হয়েছে, মুখে বলা হয়নি।
ফোনও আজ শত্রুতা করছে।যে কোন সময় চার্জ নেই হয়ে জিহানের ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলেও আমার দুই চোখে ঘুম নেই। চোখ এখন চার্জ(ঘুম) ছাড়াই জেগে থাকতে পারে।ক্লান্তি আমাকে ইদানীং ছুঁতেই পারছে না। আমার জিহান বর্তমানে সচিবালয়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসাবে কর্মরত আছে। ঢাকা ম্যাডিকেলে চান্স পেলেও বিরূপ পরিস্থিতির কারণে পড়তে পারেনি।ব্যক্তিগত জীবনে সংসারী এবং এক পুত্রের জনক।জীবনের সকল পূর্ণতায় পূর্ণ হয়েও আজো সে মনের গহীনে বড্ড একা, নিঃস্ব।অথচ জীবনে সাফল্যের সাথে এতোটা পথ পাড়ি দেয়ার পরেও জিহান ভাবে তার জীবনের সরল অঙ্কটিই কি করে যেন ভুল হয়ে গেছে।ওর মনের অস্থিরতা,শিশুর মতো সরল মনের হাহাকার আমার মনের গভীরে গিয়ে ব্যাথার বাজনা বাজায়। ওকে ব্যক্তিগত জীবনে সুখী দেখলে আমার চেয়ে কেউ বেশি খুশি হতো না। আমার জিহানের আনন্দই যে আমার আনন্দ।আচ্ছা, জিহানের সাথে যদি চলতি পথে কখনো দেখা হয়ে যায় মৌরীফুপ্পির গায়ে হলুদের সকালের অদ্ভুত দৃষ্টির শিহরণে কি এখনো ভাসবো? আলতো করে নিজেই নিজের গালের বাঁ পাশটায় ছুঁয়ে অদ্ভুত ভালোলাগায় বুঁদ হলাম।গালের এই জায়গাটাতে জিহানের ছোঁয়া আজো জীবন্ত।হাতিয়াতে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে সবাই যখন লুকিয়ে কিংবা দৌড়ে হলুদ ছোঁয়ানোর খেলায় মেতে উঠেছিল তখন আমি ভ্যাবলা কান্তের মতো জিহানের দিকে চেয়েছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন আমার মুখে হলুদ লাগাতে গিয়ে চোখে হলুদ লাগিয়ে দিল।আমার মনে হলো কেউ বুঝি আমার চোখে মরিচ লেপটে দিয়েছে। ওহ!সে কি জ্বলুনি।আমি অসহায়ের মতো প্রায় কেঁদেই দিলাম। জিহান দৌড়ে আসল, কিন্তু কিছুই করতে পারছেনা ভয়ে।যদি কেউ কিছু মনে করে। এই প্রথম আর এই শেষ বারের মতো বলে উঠলো, পানি দাও চোখে। এরপর আমার বাঁ গাল বেয়ে নেমে আসা কান্নার ফোঁটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে যে আমাকে হলুদ লাগাতে গিয়ে এই অঘটন ঘটিয়েছিল তাকে বকে যেতে লাগলো। আমি কান্না ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। এতো মায়া কেন ঐ মানুষটার মাঝে!
লেখক : হাতিয়ারই সন্তান ,জন্ম – ২৪/১২/৭৮ খ্রি:। তাঁর বাবা মাহতাব উদ্দিন আহমেদ মিলন (ম্যানেজার সোনালী ব্যাংক), ড্যাডি আবু ইউসুফ হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ বেলাল (অবসরপ্রাপ্ত জয়েন্ট সেক্রেটারি) । তিনি ইডেন কলেজ থেকে গণিতে অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় গৃহিনী হিসেবে বসবাস করছেন। তাঁর লেখা ”একটি সাধারণ মেয়ের আত্মকথন” উপন্যাস বইটি পাঠকের কাছে খুবই সমাদৃত হয়েছে । এটি তাঁর দ্বিতীয় গল্প। বইগুলো ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে বইমেলায় ৩১৩ নং স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। ০১৮১৭৫৭৯২৯৪ নম্বরে যোগাযোগ করেও কুরিয়ারের মাধ্যমে নিতে পারেন।