বালুবাসার শক্তি (ছোটগল্প)
আমেনা বেগম চম্পা
=================
একটা ভিক্ষুককে প্রায়ই দেখি শহরের ভিতরে হুইল চেয়ারে ,চেয়ারটি আরেকজন পৌঢ় লোক ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আর ভিক্ষুকটি গান গাইতে গাইতে ভিক্ষা করছে । দুর থেকে আমাকে দেখলেই ছালাম দিয়ে ট্যারা চোখ উপরে তোলে লালা ঝড়ানো মুখে অসপষ্টভাবে বলে “কিরুম আছুন আফা”? আমিও তাছিল্যের স্বরে কোনমতে ভাল বলে কেটে পড়ি। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করি সে কখনও আমার কাছে ভিক্ষা চায় না। একদিন আমি জরুরী প্রযোজনে সটকাট রাস্তা হিসেবে মসজিদের পাশে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। পিছন থেকে সেই কন্ঠস্বর আমাকে থামিয়ে দিল,
আফা ও আফা ভালা আছুন?
আমি থামলাম এবং ভিক্ষুকটিকে সেচ্ছায় কিছু টাকা দিতে চাইলাম।
ভিক্ষুকটি বলল, টাকা লাগব না আফা আফনির কাছ থেইক্যা ভিক্ষা চাওয়া শরমের ব্যাপার।
এবার আমার তার প্রতি কৌতুহল হল, জিজ্ঞাস করলাম কেন?
আমারে চিনছুইন না আফা, আমি টিক্কা, ঐযে আফনে যহন কলেজে পড়তাইন আফনেরে মাঝে মাঝে লইয়া যাইতাম তহন আমিও আফনাদের বয়সেরই আছিলাম। আফছা মনে পড়ল আমাদের পাশের গ্রামে টিক্কা নামে একজন টেম্পু চালাইত।
বললাম আপনার এই অবস্থা কেন?
আফা কি আর কইয়াম বাতাস লাগছে বাতাস। কত চিকিৎসা করছি কাম অইল না । আগে কতা কইতারছি না, অহন এট্টু ইট্টু পারি ,এই বাম আতটা একটু চলে আর কিছুই নড়াইতে পারিনা।
কথা বলে জানতে পারলাম টেম্পু চালিয়ে ভালই ইনকাম হচ্ছিল বিয়ে করছে একটা মেয়েও ছিল। হঠাৎ একদিন টেম্পু নিয়ে আসার পর আর টেম্পু থেকে নামতে পারছিল না , সবাই ধইরা নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল যাওয়ার পর দেখে এই অবস্থা । জমি জিরাত যা ছিল বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছে। কত কবিরাজ বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করিয়েছে কাজ হয়নি। দুই তিন মাস টানার পর বউ আর ল্যাংরা জামাইয়ের সাথে ঘর করতে চাইল না । সেও মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল।এরপর তার খুব কষ্ট ,তাকে দেখার কেউ ছিলনা ঘরের মধ্যে না খেয়ে প্রস্রাব পায়খানার মধ্যেই পড়ে রয়েছে। এক চাচি মাঝে মাঝে দেখত,খাবার দিত সেই বলে কয়ে পরিষদ থেকে একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে। এখন এই চেয়ারই তাকে বদলে দিয়েছে, দিন তিনশ টাকা দিয়া একজন লোক রেখেছে সে গোসল করায়, খাওয়ায় শহরে নিয়ে এসে গাড়ি ঠেলে ভিক্ষা করায়। ইনকাম ভালই, দিনে ৬ থেকে ৭ শ টাকা বা তার উপরেও হয়। আমার সময় না থাকায় সেইদিনের মত চলে গেলাম।
কয়েকদিন পর আবার সেই কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে তাকালাম, দেখলাম ২০-২২ বছরের একটি মেয়ে তার চেয়ারের হাতলে ধরে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটাও কিছুটা ট্যারা তবে দেখতে কালো হলেও একটা মায়া আছে মুখটা জুড়ে ।
বললাম এখন এই মেয়েকে ভাড়া করছেন ?
, সে জবাব দিল ভাড়া একদিনের জন্য করেনি সারাজীবনের জন্য করছি। মেয়েটি যেন লজ্জা পাচ্ছে নতুন বউয়ের মত উড়না মুখে চাপা দিয়ে হাসছে।
বললাম কিভাবে পাইলেন?
সে জবাব দিল, ভিক্ষা করতে করতে দেখা হল , সেও ভিক্ষা করতে এসেছিল তার মা আগে ভিক্ষা করত এখন ঘরে পইড়া গেছে
। জিঙ্গাস করলাম মেয়েটির আগে বিয়ে হয়নি,
জবাব দিল গরীবের বিয়া হওয়া লাগে না। ছোট বেলা থেকে ঘরের ভাঙ্গা বেড়া দিয়া এই মানুষ , সেই মানুষ শরীরে হাত দেয় যার জন্য তার মা বাসায় কাজে দিয়েছিল । ওখানেও শান্তি পাইনি দুইবার পেটের বাচ্চা নষ্ট করছে । এখন সব বাদ দিয়ে ছিরা শাড়ি পড়ে ভিক্ষায় নামছে মাকে খাওয়ানোর জন্য।
লোকটি বলে “আফা আমি সব জাইন্যাই এরে বিয়া করছি তারও একজন দরকার আমারও দরকার”।
বেশ কয়েকদিন পর রোজায় ঈদের আগে আগে টিক্কা মিয়াকে একটা অভিজাত লেডিস টেইলার্সের এখানে দেখলাম সে তার চেয়ারে বসে আছে। জিঙ্গাস করলাম, কি টিক্কা মিয়া এখানে তো ভিক্ষা পাইবা না।
সে বলল, এই লেডিস টেইলাসে তার বউয়ের জন্য জামা বানাতে দিছে , বউ ভিতরে আনতে গিয়েছে এবং সে তারে অনেক ভালবাসে ইদে ভাল কিছু দিতে চায়। বড়লোকরা যেভাবে দেয়।
দুর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম মেয়েটা জামাটা নিয়ে দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসল, চোখে কি আনন্দ ! হয়তো এমন নামকরা টেইলার্স থেকে বানানো দামি জামা কখনও পরেনি বলে। নয়তো তার ল্যাংরা ভিক্ষুক স্বামীও তাকে ঈদে বড়লোকদের মত উপহার দিতে পারে এজন্য।
খুব অবাক লাগল ভালবাসাটা আসলে র্নিভরশীলতা থেকে আসে ,এখন মেয়েটাই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ,সুখ ;দুখের অংশীদার । মেয়েটাও দেখলাম বুদ্ধিমতি সেবা যত্নে ঠিকই সাজিয়ে নিচ্ছে তার সংসার।
মসজিদের ভিতর দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় প্রায়ই খুঁজি সেই ভিক্ষুক টিক্কা আছে কি না। এখন আর তারে দেখি না। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ দেখলাম প্রচন্ড ভিড়ের মধ্য হুইল চেয়ারে চেপে এগিয়ে যাচ্ছে। জিঙ্গাস করলাম , আপনার বউ কই একা কেন? বলে তার বাচ্চা হয়েছে খুব সুন্দর একটা মেয়ে। তাদের মত ট্যারা না। তা আপনি এখন ভিক্ষা করেন কিভাবে ? জবাবে সে হাত দিয়ে চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে বলে আপা আমার শক্তি অইছে বালুবাসার শক্তি – বালুবাসার শক্তি…..বলতে বলতে সে ভিড়ের মধ্য হারিয়ে গেল।
লেখক: প্রধান শিক্ষিকা, লেতু মন্ডল হাই স্কুল, ময়মনসিংহ
Save